বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন সদ্য প্রয়াত মাহবুবে আলম। রাষ্ট্রের বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী (১৩তম অ্যাটর্নি জেনারেল) হিসেবেও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা মাহবুবে আলম গত ২৭ সেপ্টম্বর মারা গেছেন।
তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যা, সংবিধানের এয়োদশ ও ষোড়শ সংশোধনীসহ ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মাহবুব আলমের মৃত্যুর পর কে হচ্ছেন দেশের ১৪তম অ্যাটর্নি জেনারেল, এ নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক এ পদে সরকার কাকে নিয়োগ দেবে তা নিয়েও আদালত পাড়ায় চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, করোনায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মারা যাওয়ায় এ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জোর লবিং চালাচ্ছেন আওয়ামীপন্থি জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা। এরইমধ্যে কয়েকজনের নাম খুব জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে।
তাদের মধ্যে রয়েছেন- অ্যাটর্নি জেনারেলের জুনিয়র আইনজীবী ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির বর্তমান সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, মো. মমতাজ উদ্দিন ফকির, এস এম মুনির, আজমালুল হোসেন কিউসি, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান, কামরুল হক সিদ্দিকী, মনসুরুল হক চৌধুরী ও নিহাদ কবির প্রমুখ। এছাড়াও আওয়ামীপন্থি প্রভাবশালী একাধিক আইনজীবীর নামও শোনা যাচ্ছে।
এ এম আমিন উদ্দিন: সাম্প্রতিক সময়ে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিনের নাম সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে বেশি আলোচিত হচ্ছে। দীর্ঘ দিন পর বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের পরাজিত করে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি পদে পর পর দুইবার তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তাঁর নিয়োগের সম্ভাবনার কথাও বলছেন অনেকে। অনেকে এ এম আমিন উদ্দিন অ্যাটর্নি জেনারেল হলে তিনি মাহবুবে আলমের ‘যোগ্য উত্তরসূরী’ হবেন বলেও মন্তব্য করেছেন।
মুরাদ রেজা, মো. মমতাজ উদ্দিন ফকির ও এস এম মুনির: রাষ্ট্রের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করা তিনজনের মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল হওয়ার জন্য এগিয়ে আছেন মুরাদ রেজা।
কারণ তার দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ করার আগ পর্যন্ত মুরাদ রেজাই ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করবেন এটা মোটামুটি নিশ্চিত। আবার তিনজন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের মধ্যে তিনিই জ্যেষ্ঠতার দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছেন। তিনি বিভিন্ন সময় অ্যাটর্নি জেনারেলের অবর্তমানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। দক্ষতার বিচারে মো. মমতাজ উদ্দিন ফকিরও অ্যাটর্নি জেনারেল হওয়ার দাবিদার। তিনিও দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসিবে দায়িত্বি পালন করছেন।
এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক এস এম মুনীর করোনাকালে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। বিষয়টিকে অনেকে তার ওপর সরকারের সুদৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করছেন। অতীতে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার নজিরও রয়েছে।
আজমালুল হোসেন কিউসি: সিনিয়র এ আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। বাংলাদেশে তিনিই একমাত্র আইনজীবী যিনি ব্রিটেনের কুইন্স কাউন্সিল থেকে কিউসি পদধারী। আজমালুল হোসেন কিউসি আলোচিত মুন সিনেমা হলের মামলা দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন এবং আপিল বিভাগ থেকে ক্ষতিপূরণের আদেশও পেয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন মামলায় তিনি আইনজীবী হিসেবে ছিলেন।
নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগের গুঞ্জনে সিনিয়র আইনজীবী এম কে রহমান ও কামরুল হক সিদ্দিকীর নামও আলোচনায় রয়েছে। এই দুই আইনজীবীর সততা ও দক্ষতার সুনাম রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে।
এ ছাড়া সিনিয়র আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরীও অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন বলে অনেকেই মনে করছেন। ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ মনসুরুল হক চৌধুরীর সংশ্লিষ্ট মহলে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
এদিকে নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিহাদ কবিরের নামও বেশ জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে আইনজীবীদের বিভিন্ন আলোচনায়। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী সরকার দেশের প্রথম নারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে আইনজীবী নিহাদ কবিরকে নিয়োগ দিলে আশ্চর্যের কিছু হবে না। এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ সুপ্রিম কোর্টে সিভিল প্র্যাকটিস করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল সরকারকে সংবিধান, সাধারণ আইন, আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইনগত পরামর্শ দেন। সরকারের পক্ষে আদালতে উপস্থিত থাকেন। সংবিধানের ৬৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন অ্যাটর্নি জেনারেল। সংবিধানের ৬৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হওয়ার যোগ্য কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দান করবেন। উপ-অনুচ্ছেদ ৪-এ বলা হয়েছে, তিনি রাষ্ট্রপতির সন্তোষ অনুযায়ী স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দায়িত্বগ্রহণের এক সপ্তাহ পর অ্যাটর্নি জেনারেল পদে পরিবর্তন আসে। বিদায় নেন জরুরি অবস্থার সরকারের সময়ে নিয়োগ পাওয়া অ্যাটর্নি জেনারেল সালাহউদ্দিন আহমেদ। তার স্থলে দেশের ১৩তম অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি নিয়োগ পান সিনিয়র আইনজীবী মাহবুবে আলম। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ১১ বছর ৮ মাস ১৪ দিন তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে ‘অ্যাটর্নি জেনারেল’ পদটি শূন্য হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধকালে ১৯৭১ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এম এইচ খন্দকার। স্বাধীন বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার পর প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন ফকির শাহাবুদ্দিন আহমেদ। তিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
সময়ের ধারাহিকতায় সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ (১৯৭৬), মোস্তাফা কামাল (পরবর্তীতে বিচারপতি, ১৯৭৭), রফিক উল হক (১৯৯০), আমিনুল হক (১৯৯১), কে.এস. নবী (১৯৯৬), মাহমুদুল ইসলাম (১৯৯৮), এএফ হাসান আরিফ (২০০১), এ. জে. মোহাম্মদ আলী (২০০৫), ফিদা এম. কামাল (২০০৭), সালাহউদ্দিন আহমেদ (২০০৮) এবং সর্বশেষ মাহবুবে আলম (২০০৯-২০২০) পর্যায়ক্রমে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশের দীর্ঘতম সময় ধরে (১১ বছর) এ পদে দায়িত্ব পালন করে রবিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) না ফেরার দেশে পাড়ি জমান মাহবুবে আলম।