ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রতিটি সরকারি অফিসের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হয়েছিল ২৪ হাজার ওয়েবসাইট। উদ্দেশ্য ছিল সরকারি সব কার্যক্রম সম্পর্কে সার্বক্ষণিক আপডেট থাকা এবং জনসাধারণকেও তাৎক্ষণিকভাবে হালনাগাদ কাঙ্ক্ষিত তথ্য দেওয়া। অথচ অধিকাংশ ওয়েবসাইটই ভুল তথ্যে ভরা, হালনাগাদও হচ্ছে না বছরের পর বছর।
একটি ওয়েবসাইটে একজন মৃত এমপিকে এখনও জীবিত হিসেবে দেখানো কিংবা অবসর নেওয়া কর্মকর্তাকে কর্মরত হিসেবে যুক্ত রাখা- এ রকম নানা ভুলে ভরা সরকারি ওয়েবসাইটগুলো। এসব ওয়েবসাইট দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কী করছেন- এ প্রশ্ন এখন সবার।
এ ধরনের ঘটনা সরকারি শৃঙ্খলার পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মত দিয়েছেন সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, কিছু দায়িত্বহীন কর্মকর্তার কারণে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রম ভেস্তে যেতে বসেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি বিধি অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের অধিকাংশ ওয়েবসাইটই পুরোনো তথ্যে ঠাসা। এতে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন সঠিক তথ্যপ্রাপ্তির ন্যায্য অধিকার থেকে। সরকারি সেবার বিভিন্ন তথ্য সাধারণ মানুষ অবাধে না জানার ফলে মাঠপর্যায়ে দুর্নীতিও বাড়ছে। একইভাবে মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটগুলোতেও প্রয়োজনীয় তথ্য মিলছে না।
কিছু বিষয় শুধু ইংরেজি ভাষায় তৈরি হওয়ায় অনেক ব্যবহারকারী সহজে ব্যবহার করতে পারছেন না। তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও বিপুল অর্থ ব্যয়ে সরকারি বিভিন্ন প্রতিবেদন ও প্রকাশনা বিজি প্রেসে ছাপানো হচ্ছে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। অথচ কভিড-১৯ শুরুর পর থেকে সাধারণ মানুষ অনলাইনে সক্রিয় হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও অনলাইনে সক্রিয়ভাবে অফিস পরিচালনা করছে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রংপুর, সিলেট ও রাজশাহী বিভাগের শতাধিক জেলা ও উপজেলার সরকারি ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, এতে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী যে তথ্যগুলো স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রকাশ করার কথা, সেগুলোই নেই। তাছাড়া দপ্তরের কার্যক্রম, গুরুত্বপূর্ণ নোটিশ, কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য, বিভিন্ন সভার কার্যবিবরণী, উন্নয়ন প্রকল্পের তথ্য, সুবিধাভোগীদের তালিকা এগুলোও নেই অধিকাংশ ওয়েবসাইটে।
দীর্ঘদিন ধরে হালনাগাদ হচ্ছে না এসব ওয়েবসাইট। অথচ এগুলো দেখার জন্য প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সভাপতিত্বে আইসিটিবিষয়ক একটি কমিটি রয়েছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন) নেতৃত্বে আইসিটিবিষয়ক কমিটি আছে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর জেলা-উপজেলার ওয়েবসাইটগুলোতে দেখা যায়, কেরানীগঞ্জ উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে নাম রয়েছে প্রভাকর সাহার। অথচ তিনি প্রায় ১০ বছর আগে পদোন্নতি পেয়ে এ উপজেলা থেকে বদলি হয়ে গেছেন। এখন তিনি অবসরের যাওয়ার পর্যায়ে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নাসিম গত ১৩ জুন এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য সাহারা খাতুন গত ৯ জুলাই মারা গেছেন।
কিন্তু সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা জেলার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, মোহাম্মদ নাসিম এবং সাহারা খাতুন এখনও জীবিত ও সংসদ সদস্য। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ফরম নামে একটি বিভাগ আছে। এর মধ্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের মনোনয়ন, মন্ত্রণালয়ভিত্তিক প্রতিবেদন, পরিদর্শন প্রতিবেদন ও অন্যান্য বিষয় থাকলেও এ-সংক্রান্ত কোনো ফরম নেই। সেবাসংক্রান্ত এসব ফরম কোথায়, কীভাবে পাওয়া যাবে এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। একাধিক মন্ত্রণালয়ে মাসিক সমন্বয় সভার কার্যবিবরণীবিষয়ক বিভাগ আছে।
সেখানে এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। সব তথ্য ও সেবা এক ঠিকানা ও ডিজাইনে পাওয়ার লক্ষ্যে জাতীয় তথ্য বাতায়নে প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরকে যুক্ত করা হলেও বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইট রয়েছে নিজস্ব ডিজাইনে। পুলিশের পুরো ওয়েবসাইট করা হয়েছিল ইংরেজিতে। এতে তথ্য পেতে ভোগান্তি হতো সাধারণ মানুষের। তবে সম্প্রতি বাংলা ভার্সন চালু করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ, নৃবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, প্রতিবেদন তৈরির কাজে প্রায়ই তাদের বিভিন্ন তথ্যের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ওয়েবসাইটে দেওয়া থাকে না বলে সংগ্রহ করতে কষ্ট হয়। অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো তথ্য দিয়েই কাজ চালাতে হয়। সংবাদ তৈরির কাজে প্রায়ই সরকারি বিভিন্ন ওয়েবসাইটের শরণাপন্ন হতে হয় গণমাধ্যমকর্মী জাহিদ হাসানকে। তিনি বললেন, সরকারি অনেক ওয়েবসাইটে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায় না। কারণ বেশিরভাগ ওয়েবসাইটই সরকার ও মন্ত্রণালয়ের গুণকীর্তনে ভরা- প্রয়োজনীয় কিংবা হালনাগাদ তথ্য মেলা ভার।
কেরানীগঞ্জ উপজেলার ইউএনও ও আইসিটিবিষয়ক কমিটির সভাপতি অমিত দেবনাথ ওয়েবসাইট হালনাগাদ না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ওয়েবসাইটে অনেক দপ্তরের তথ্য ভুল আছে। উপজেলা নির্বাচন কমিশনের দপ্তরে ইউএনওর নাম্বার দেওয়া আছে। তাই অনেক মানুষ আমাকেই ফোন দিয়ে বিরক্ত করে। তিনি বলেন, আইসিটি কাজের জন্য প্রতিটি উপজেলায় টেকনিশিয়ানের পদ আছে। কিন্তু এ পদে কোনো জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কেরানীগঞ্জ উপজেলার সহকারী প্রোগ্রামারকে নবাবগঞ্জ উপজেলায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। একজন কর্মকর্তা দুই উপজেলায় দায়িত্ব পালন করায় অনেক কাজ করা সম্ভব হয় না।
অর্ধশতাধিক উপজেলা সহকারী প্রোগ্রামার বলেন, উপজেলার প্রতিটি অফিসের ই-নথি, ওয়েব পোর্টাল হালনাগাদসহ আইসিটির সব কাজ তাদের করতে হয়। একজন কর্মকর্তার পক্ষে সব দপ্তরের কাজ করা অনেক কঠিন। এজন্য প্রতিটি উপজেলায় একজন কম্পিউটার অপারেটর খুবই প্রয়োজন। তাদের পদও সৃজন করা আছে। নানা জটিলতায় এ পদে কোনো নিয়োগ হচ্ছে না।
নকলা উপজেলার সহকারী প্রোগ্রামার সাইমুন শাহনাজ বলেন, আইসিটি-সংক্রান্ত সব কাজই তারা করেন। ওয়েবসাইটের তথ্য হালনাগাদের জন্য দপ্তরপ্রধানদের কাছে নিয়মিত তথ্য চান। অনেকে তথ্য দিতে চান না। তথ্য না পেলে তারা নতুন তথ্য আপলোড করতে পারেন না। এজন্য কর্মকর্তাদের সচেতন করা প্রয়োজন। অর্থ বিভাগের সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. আব্দুস সালাম শাহ বলেন, তারা মন্ত্রী, সচিব ও উইংপ্রধানদের অনুমোদন নিয়ে ওয়েবসাইটে তথ্য আপলোড করেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম বলেন, হালনাগাদ না হওয়ার বিষয়টি সত্য। তবে কর্মকর্তাদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণের পরও সচেতন না হলে সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে সচিবালয়ের নির্দেশনায়ও সব বলা আছে। তিনি বলেন, তথ্য আপলোডের কাজটি খুবই সহজ। এজন্য অতিরিক্ত কোনো জনবলের প্রয়োজন হয় না। প্রতিটি দপ্তর নিজেই এ কাজ করতে পারে। এর পরও উপজেলা পর্যায়ে একজন সহকারী প্রোগ্রামার আছে। যেসব উপজেলায় নেই, সেখানে পর্যায়ক্রমে নিয়োগ করা হবে। এ ছাড়া প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে আইসিটি-সংক্রান্ত আলাদা শাখা রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের একাধিক সচিব বলেন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। এই পদ্ধতি চালু হলে সরকারি ফাইল আর গায়েব হওয়ার সুযোগ থাকবে না, নষ্টও হবে না। শত বছর পরও একটি ফাইল খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে এর জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কারণ, এটি কার্যকর হলে ঘুষ বন্ধ হয়ে যাবে, কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, ফাইল গায়েব করা যাবে না। ফলে এটি ঠেকানোর জন্য একটি চক্র তৈরি হয়েছে। এটি যেন বাস্তবায়ন না হয়, সে জন্য তারা কাজ করছে।
সচিবরা জানান, জনগণকে সরকারি সব সেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে দিতে সরকার 'এক সেবা' প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। ডিজিটাল দেশ বিনির্মাণ ঘোষণার ১২ বছর পর ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি মাইগভ. অ্যাপ থেকে সরাসরি সরকারি দপ্তরে অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে, যা ই-নথির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। সেবাপ্রার্থীদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। তবে একসেবা ও মাইগভ. অ্যাপের মাধ্যমে বর্তমানে মাত্র ১৭২টি সরকারি সেবা অনলাইনে আবেদন করা যায়। অথচ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরের প্রায় দুই হাজার ৫০০ সেবার জন্য জনগণকে আবেদন করতে হয়। ফলে ৯৩ দশমিক ১২ শতাংশ আবেদন সেবা এখনও অনলাইনে চালু হয়নি। অথচ সরকারের রূপকল্প (ভিশন) অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের আর মাত্র এক বছর বাকি।
এ ব্যাপারে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, সরকারি ওয়েবসাইটগুলো করা হয়েছিল মানুষকে সহজে তথ্য দেওয়ার জন্য। মানুষ আগে যে তথ্য পাওয়ার জন্য সরকারি দপ্তরে যেত, তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের সময়ে সেই তথ্য যেন ঘরে বসেই পেয়ে যায়, সে জন্যই ওয়েবসাইট। একইসঙ্গে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনেক ধরনের আবেদন, অনুরোধের কাজগুলোও মানুষ ঘরে বসে করতে পারবে, এমন লক্ষ্যও ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি ওয়েবসাইটগুলো 'ইন্টারঅ্যাকটিভ' নয়। অর্থাৎ এখানে একপক্ষ কিছু তথ্য প্রথমবার দিয়ে রাখে, পরে সেগুলো আর হালনাগাদও করা হয় না। এখানে কোনো আবেদন করলে তারও কোনো প্রতি উত্তর আসে না। এর কারণ, কর্তৃপক্ষের মাইন্ডসেটটাই তৈরি হয়নি তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য। কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীল না হলে ওয়েবসাইটের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত হবে না।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, সরকার ডিজিটাল দেশ গড়ার লক্ষ্যে ২০১২ সালে বিপুল অর্থ ব্যয়ে ২৪ হাজার ওয়েবসাইট তৈরি করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ওয়েবসাইট ভুল তথ্যে সয়লাব হয়ে আছে। এতে সাধারণ মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ব্যাহত হচ্ছে সরকারের উদ্দেশ্য। তিনি আরও বলেন, সরকারি সব ওয়েবসাইট হালনাগাদ করার জন্য প্রকল্প নেওয়া প্রয়োজন। কারণ, সরকারি অনেক কর্মকর্তার তথ্যপ্রযুক্তির কাজে অনীহা রয়েছে।