সাত মাসের বেশি সময় ধরে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ফলিতবিজ্ঞান ও মানবিক অনুষদের ডিন ড. সাজ্জাদ হোসেন। এই সময়ে নতুন উপাচার্য (ভিসি) নিয়োগের কথা থাকলেও তা এখনো সম্পন্ন হয়নি। রুয়েটের উপাচার্য হওয়ার জন্য প্রথম দফায় জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়া কেউই নিয়োগ পাননি। ফলে দ্বিতীয় দফায় আবারও দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। তবে এসব প্রার্থীর অধিকাংশের বিরুদ্ধেই বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, রুয়েটের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম সেখের উপাচার্য থাকার মেয়াদ শেষ হয় গত ৩০ জুলাই (২০২২)। এর এক দিন পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রুয়েটের ফলিতবিজ্ঞান ও মানবিক অনুষদের ডিন ড. সাজ্জাদ হোসেনকে রুয়েটের ভারপ্রাপ্ত ভিসির দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর সাত মাস ধরে রুয়েট পরিচালনা করছেন ভারপ্রাপ্ত ভিসি।
রুয়েট সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাইয়ে কিছু অধ্যাপক ভিসি হওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়ে দিয়েছিলেন। কেউ কেউ এমপি-মন্ত্রীর সুপারিশ নিয়েও মন্ত্রণালয়ে তদবির করেন। কিন্তু তখনকার একজনেরও জীবনবৃত্তান্ত বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় দফায় আবার জীবনবৃত্তান্ত নেওয়া হয়। এবার উপাচার্য হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অন্তত ডজনখানেক অধ্যাপক। এর মধ্যে প্রথম দফায় চেষ্টা করা কয়েকজনও রয়েছেন। নতুন করে উপাচার্য প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন: সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এনএইচএম কামরুজ্জামান সরকার, একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. তারিফ উদ্দিন আহম্মদ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসেন, গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীমুর রহমান। তবে এর বাইরেও আরো একাধিক শিক্ষক রয়েছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
এছাড়া প্রথম থেকেই ভিসি হওয়ার দৌড়ে আছেন সদ্য সাবেক ভিসি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ড. রফিকুল ইসলাম সেখ, সাবেক ভিসি যন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল আলম বেগ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ড. আবদুল আলীম, যন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. নীরেন্দ্রনাথ মুস্তফী, একই বিভাগের ড. এমদাদুল হক, তরিৎ ও কম্পিউটার কৌশল অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম মন্ডল ও ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আশরাফুল হক।
ভিসি হওয়ার চেষ্টায় থাকা এসব অধ্যাপকের বিভিন্ন জনেরই নানারকম বিতর্ক রয়েছে। ড. নীরেন্দ্রনাথ মুস্তফী ভিসি হতে খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার, নওগাঁ-৩ আসনের এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদার ও রাজশাহী-২ আসনের এমপি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার সুপারিশপত্র জমা দিয়েছেন। এসব সুপারিশপত্র ফাঁস হলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এর আগে ড. মুস্তফী জ্যেষ্ঠতা লক্সঘন করে অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভাগীয় সভাপতি হয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাবেক দুই ভিসি রফিকুল আলম বেগ ও রফিকুল ইসলাম সেখ আবারও ভিসি হওয়ার চেষ্টা করলেও তাদের নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
রুয়েটের সাবেক অধ্যাপক হলেন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আশরাফুল হক। তিনি এক যুগ আগে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। এরপর গাজীপুরে বেসরকারি ইসলামিক ইউনির্ভাসিটি অব টেকনোলজিথতে অধ্যাপনা শুরু করেন তিনি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে তিনি রুয়েটের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হকের ঘণিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এছাড়া ওই সময়ে তিনি রুয়েটে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তাকে রুয়েটের ভিসি করতে একটি পক্ষ জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে রুয়েটের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, অধ্যাপক আশরাফুল হক রুয়েট থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। এমন একজন ব্যক্তিকে রুয়েটের ভিসি পদে নিয়োগ দিতে মহল বিশেষের তৎপরতাকে অনেকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। অধ্যাপক আশরাফুল হক ভিসি হলে বিতর্কিত সদ্য সাবেক ভিসি রফিকুল ইসলাম সেখ খুশি হবেন বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ ওই সময়ের ছাত্র-শিক্ষক হিসেবে তাদের মধ্যে এখনো অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক বিরাজমান। সেই সুবাদে রফিকুল ইসলাম সেখ তার সময়কার নানা নিয়োগসহ বিতর্কিত কান্ডে অভিযুক্ত থেকে পরিত্রাণ পাবার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
সূত্র বলছে, আরেক প্রার্থী কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম মন্ডল গবেষণার জন্য এক বছরের ছুটি নিয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে চাকরি করেন। নিয়মবহির্ভূতভাবে একই সময়ে দুই প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। এ বিষয়ে তার ব্যাপারে রুয়েটে তদন্ত হয়েছে। সিন্ডিকেট তার গবেষণা ছুটি বাতিল করে নিয়মিত ছুটি মঞ্জুরের পক্ষে মত দিয়েছে। এছাড়া ওই সময়ে রুয়েট থেকে নেওয়া অর্থ ফেরত দেওয়ারও নির্দেশনা দিয়েছে।
ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. ফারুক হোসেন রুয়েট গবেষণা সম্প্রসারনের পরিচালকসহ রুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি তিনি। তার বিরুদ্ধে রুয়েটে নিয়োগ ও লাইব্রেরীতে ফটোকপি বই ক্রয়ে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। তার নিকট আত্মীয়সহ বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত একাধিক ব্যক্তিকে অর্থের বিনিময়ে চাকরি দিতে সহযোগিতা করার অভিযোগও রয়েছে।
ভিসির দৌড়ে থাকা ড. শামীমুর রহমান সাবেক ভিসি সিরাজুল করিম চৌধুরীর আমলে ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা ছিলেন। শামীমুর রহমানের বিরুদ্ধেও ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা ও বিতর্কিত কর্মকান্ডের অভিযোগ রয়েছে। আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুজ্জামানের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিতর্কিত কর্মকা-ের অভিযোগ। এছাড়া তার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সাথে সখ্যতা থাকার অভিযোগও রয়েছে। যদিও তিনি এ অভিযোগ এরআগে অস্বীকার করেছেন।
জানা গেছে, সম্ভাব্য ভিসি প্রার্থীদের মধ্যে ড. এনএইচএম কামরুজ্জামান সরকার রয়েছেন। তার পুরো পরিবার রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার বাবা নুরুল হুদা সরকার রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। বড় ভাই আসলাম সরকার মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য ড. মো. আবু তাহের এরআগে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়। উপাচার্য হতে অনেকেই চাইতে পারেন, কিন্তু হবেন একজন। সবদিক থেকে ভালো একজনকে খুঁজতে হয়তো একটু সময় লাগছে। মন্ত্রণালয় কাজ করছে। দ্রুতই উপাচার্য নিয়োগ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে রুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং ভিসি প্রার্থী আশরাফুল হক বলেন, রুয়েটে আমি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে শিক্ষকতা করেছি। আমি সবসময় চাইবো রুয়েট ভালো মত চলুক। এছাড়া ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে অধ্যাপক আশরাফুল হক বলেন, সরকার যাকে যোগ্য মনে করবেন, যার চলাচল এবং প্রোফাইল ভালো তকেই নিয়োগ দিবেন।