ঢাকা মঙ্গলবার, নভেম্বর ২৬, ২০২৪
দিনাজপুরে তীব্র তাপদাহে লিচু ফলন বিপর্যয়ের আশংকা
  • শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর
  • ২০২৩-০৫-১০ ০০:২৯:২৪
প্রচণ্ড দাবদাহে দিনাজপুরে লিচু ফলন বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিয়েছে।পরিপক্কের আগেই গাছে লিচু পাকা শুরু হয়েছে। কোথাও কোথাও গাছে ফেটে গেছে যাচ্ছে লিচু। আবার কোথাও লিচু শুকিয়ে ঝরে পড়ছে। দিনাজপুর জেলার বাজারে মৌসুমের প্রথম লিচু আসে ১৫ মের পর। সে হিসেবে দানা বড় এবং পরিপক্ব হতে আরও এক সপ্তাহ প্রয়োজন। কিন্তু প্রচণ্ড দাবদাহে আগাম পাকতে শুরু করেছে লিচু। এতে লিচুতে স্বাদ কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে লিচুর দাম নিয়েও এবার শংকায় চাষী-বাগানি ও ব্যবসায়ীরা। গত কয়েকদিন ধরে দিনাজপুরের বয়ে যাচ্ছে প্রচন্ড তাপপ্রবাহ। তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে তাপদাহের তীব্রতা। দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্ততের উপপরিচালক মো.নুরুজ্জামান জানিয়েছেন,এসময় লিচু রক্ষার জন্য গাছের গোড়ার পর্যাপ্ত পানি দেয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কারণ মৌসুমের প্রথম মাদ্রাজি জাতের লিচু বাজারে আসে ১৫ মের পর। এরপর জুনের প্রথম সপ্তাহে বেদানা, ১৫ জুনের পর বাজারে আসে বোম্বাই লিচু। এরপর চায়না-১, ২ ও ৩ জাতের এবং সবশেষ আসে কাঁঠালি ও মোজাফ্ফরি জাতের লিচু। কিন্তু চলতি সপ্তাহেই মাদ্রাজি লিচু বাজারে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু, স্বাদ নেই লিচুতে।দানা ছোট।ল এবং বিচি বেশি বড়। এভাবে তাপদাহ অব্যাহত থাকলে অধিকাংশ লিচু নষ্ট হয়ে যাবে। এমনটাই মনে করছেন,সংশ্লিষ্টরা।জেলায় এবার পাঁচ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে লিচুর বাগান রয়েছে। এ বাগানগুলোতে লিচু উৎপাদন হয় প্রায় ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। তবে আবহাওয়া বিরূপ হওয়ায় এবার উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। দিনাজপুর কসবা এলাকায় লিচু বাগানি আরমান হোসেন জানান মাদ্রাজি লিচু একটু আগেই বাজারে আসে, কিন্তু এবার গরমে বেশি আগেই লিচু পাকতে শুরু করেছে। সেই সাথে বেদানাও পাকছে। আকারে এখনো ছোট আছে লিচু।পরিপক্ক না হতেই অসময়ে পাকছে লিচু। বৃষ্টি দেরিতে হওয়ায় দানাও ছোট হয়েছে। সামান্য শিলবৃষ্টিতে লিচুর অনেক ক্ষতি হয়েছে। শিলায় আঘাত পাওয়া লিচু ফেটে পচে যাচ্ছে। জানি না এবার লাভ হবে কি না। মাসিমপুর এলাকার লিচু চাষি মোকাররম হোসেন জানালেন, গরম আর রোদে লিচুর সবুজ চামড়া পুড়ে লাল এবং খয়নি বর্ণ ধারণ করেছে। একারণে এবার আগেই লিচু পাড়তে হবে। অপরিপক্ব লিচু পেকে যাওয়ায় মিষ্টিও কম এবং স্বাদও নেই। লিচুর দানা বড় করার জন্য কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে প্রতিদিন গাছের গোড়ায় সেচ দেওয়া হচ্ছে। ভিটামিন জাতীয় ওষুধ স্প্রে করছি। কিন্তু, এতে কাজ হচ্ছেনা। দিনাজপুর সরকারি কলেজের অধ্যাপক উদ্ভিদবিদ দেলোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, অব্যাহত তাপপ্রবাহ ও উচ্চ তাপমাত্রার কারণে লিচুতে দ্রুত রং আসতে শুরু করেছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে অন্য বছরের চেয়ে এবার লিচুতে দ্রুত রং এসেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উদ্ভিদ বায়োক্লকে পরিবর্তন আসছে। আগামীতে এ ধরনের পরিবর্তন আরও স্পষ্ট হতে পারে। যা বাগানিদের জন্য খুবই ক্ষতিকারক। দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. এ এইচ এম বোরহান-উল-ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, 'ভোক্তাদের অপরিপক্ক লিচু খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে। এসময় বাগানিরা লিচুর রং এবং আকার ঠিক রাখার জন্য গাছেই লিচুতে কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকে। অধিক লাভের আশায় তা বাজারে বিক্রি করে। অপরিপক্ক লিচু খেলে মানুষের নানান ধরনের সমস্যার আশংকা রয়েছে। অপরিপপ্প লিচু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক শিশুদের জন্য। এমনকি এ লিচু খেলে শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে।' দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো.নুরুজ্জামান জানান,গত বছর জেলায় লিচুর চাষ হয়েছিল পাঁচ হাজার ৪৮০ হেক্টর জমিতে। এবার ১০ হেক্টর বেড়েছে। গতবার ৬১৬ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হলেও এবার ৭০০ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।তবে আবহাওয়া বিরূপ হওয়ায় এবার উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। দিনাজপুরে লিচু ভাঙার সময় এখনও আসেনি। কোনো অসাধু ব্যবসায়ী অপরিপক্ক লিচু বিক্রি করলে প্রয়োজনে অভিযান পরিচালনা করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।' জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দিনাজপুরের সহকারী পরিচালক মমতাজ বেগম জানান, 'দিনাজপুরের লিচু নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে মিটিং হয়েছে। ক্যামিকেল বা রং ব্যবহারের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে অপরিপক্ক লিচু বাজারে বিক্রি করতে দেয়া হবেনা বলেও মিটিংয়ে লিচু নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।' দিনাজপুর নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের অফিসার মো. মুসফিকুর রহমান জানিয়েছেন, 'আমরা বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে প্রচারণা শুরু করেছি। অপরিপক্ক লিচু খেলে তেমন সমস্যা নেই, কিন্তু যদি ক্যামিকেল বা রং ব্যবহার করে লিচু আকর্ষণীয় করে বাজারে বিক্রি করা হয় এবং সেই লিচু মানুষ খায় তাহলেই সমস্যা। এ বিষয়ে কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।' ‘চাল-লিচুতে ভরপুর, জেলার নাম দিনাজপুর।’ জেলা ব্র্যান্ডিং এর শ্লোগান এটি। লিচুর রাজ্য হিসেবে সুনামও ছড়িয়েছে দিনাজপুরের। ১৩টি উপজেলাতেই কম বেশি লিচুর আবাদ হয়। সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সদর উপজেলার মাসিমপুর, উলিপুর, আউলিয়াপুর, মহব্বতপুর, বিরলের মাধববাটি, রবিপুর, রাজারামপুর, মহেশপুর, বটহাট এবং চিরিরবন্দর-খানসামা উপজেলায়। মূলত লিচু চাষের জন্য উপযোগী এ অঞ্চলে লিচু চাষে কৃষকের আগ্রহও দিন দিন বাড়ছে। সাধারণত বাংলা জৈষ্ঠ্য মাসের শুরুতে দিনাজপুরের লিচু পাকতে শুরু করে। চাষিরা বলছেন, আবহাওয়ার কারণে এবার লিচুর পাকছে আগেভাগেই। লিচু বাগান ঘুরে দেখা যায় গাছে গাছে থোকায় থোকায় ঝুলে আছে সবুজ আর অপরিপক্ব লাল রঙের লিচু। ফলের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়ছে অনেক গাছের ডালগুলো। বিরল উপজেলার রবিপুর এলাকার লিচু চাষি মতিউর বলেন, ১৭ বিঘা জমিতে লিচু বাগান আমার। বেদানা ও মাদ্রাজীর ফলন কম। কৃত্রিম সেচ দিয়ে যাচ্ছি। গতবার ২৫ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করেছি। তবে এবার অন্তত ৪০ শতাংশ ফলন কমেছে। সদরের মাদারগঞ্জ এলাকার লিচু চাষি মোমিনুল ইসলাম ঢাকা জানান, আগাম জাতের মাদ্রাজী লিচুর ফলন কম হয়েছে ও আকারে ছোট হয়েছে। ঠিকমতো বৃষ্টি না হওয়ায় এবং প্রচন্ড তাপদাহে এমনটা হয়েছে । তবে বোম্বাই লিচুর ফলন এবার সব গাছে মোটামুটি ভালো। আশা করছি বাজারে লিচুর দাম ভালো পাবো। আগমী ১০ দিনের মধ্যে দিনাজপুরের মাদ্রাজী লিচু বাজারে পাওয়া যাবে। স্বাদে, গন্ধে দিনাজপুরের লিচুই দেশে সেরা দাবি এখানকার চাষিদের। আগে শহরের নিউ মার্কেটে লিচুর পাইকারি বাজার বসলেও করোনাকালীন থেকে দিনাজপুরের গোর-এ- শহীদ বড় মাঠের একাংশে গত ৩ বছর ধরে দেশের বৃহত্তম এই লিচুর বাজার বসে। মৌসুমি এই ফলের উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে এই বাজার চলে প্রায় এক থেকে দেড় মাস। এখান থেকেই মূলত দিনাজপুরের উৎপাদিত লিচু চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এ ছাড়া, অনেক বাগান থেকেও সরাসরি ট্রাকে করে লিচু নিয়ে যাওয়া হয় দেশের বিভিন্ন জেলায়। লিচুর মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের দিনাজপুরের লিচুর প্রতি থাকে অন্যরকম এক টান। জেলার বিস্তৃত লিচু বাগানগুলোতে গাছে গাছে পাকা লিচু দেখা ও গাছ থেকে সংগ্রহ করে খাওয়াও আরেক ধরনের মজা। এজন্য প্রতি বছর বিভিন্ন জেলা থেকে এসময় দিনাজপুরে ঘুরতে আসেন অনেকেই। দিনাজপুর সদরের মাসিমপুর এলাকার লিচু চাষি রবিউল ইসলাম জানান, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় এ বছর লিচুর উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ কম হবে। মূলত এ বছর মুকুল আসার সময় তাপমাত্রা ওঠা-নামা করা, অসময়ে কুয়াশা ও বিভিন্ন সময় শিলাবৃষ্টি, বর্তমানে প্রচন্ড তাপদাহ সামগ্রিকভাবে লিচুর উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে। বেশ কয়েকটি বাগানে এ বছর লিচুর আকারও ছোট হয়েছে বলে জানান চাষিরা। এখন শেষ মুহূর্তে বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগান মালিকরা। গাছের লিচুকে হৃষ্টপুষ্ট করতে হরমোনসহ বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করছেন তারা।
মাউশির প্রদর্শক ও গবেষণা সহকারি পদের ফল প্রকাশের দাবিতে মানববন্ধন
পঞ্চগড়ে ভারী বর্ষণে ভেঙে গেছে সড়ক, বন্ধ যান চলাচল
পলাশে ঘণ ঘন লোডশেডিং, ৪ হাজার মুরগীর মৃত্যু