অভিজ্ঞতা সনদে অভিযুক্ত শিক্ষক ; নিয়োগকারীর বিরুদ্ধেও রয়েছে গুরুতর অভিযোগ
- মাহতাবুর রহমান, আমতলী, বরগুনা
-
২০২২-১০-১৭ ০৩:৪৭:৩৯
- Print
বরগুনার আমতলী উপজেলার আঠারোগাছিয়া ইউনিয়নে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে নীল কমল বিশ্বাস গড়ে তোলেন উত্তর সোনাখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠান উত্তর সোনাখালী স্কুল এন্ড কলেজ নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান সহকারী প্রধান শিক্ষক জাহিদুল ইসলাম ২০১৫ সালে উক্ত প্রতিষ্ঠানে যোগদান করার পূর্বে ২০০৫ সালে উত্তর কালামপুর বালিকা দাখিল মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক (কৃষি) হিসেবে নিয়োগ পান, নিয়োগের সময় তার সকল একাডেমিক সনদের সাথে দ্যা পিপলস টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের কৃষি ডিপ্লোমা সনদ দাখিল করেন। ২০১৫ সালে পূর্বের চাকরির অভিজ্ঞতা অনুসারে উত্তর সোনাখালী স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম সহকারি প্রধান শিক্ষক জাহিদুল ইসলামের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। কিন্তু বিপত্তি বাধে সর্বশেষ ০২ এপ্রিল ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে।
উত্তর সোনাখালী স্কুল এন্ড কলেজের আজীবন দাতা সদস্য মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন ফিনান্সিয়াল পোস্টকে বলেন, সহকারী প্রধান শিক্ষক জাহিদুল ইসলাম দূর্নীতিবাজ বরখাস্তকৃত কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ নূরুল ইসলামের সমর্থন করা থেকে বিরত থাকেন এবং সকল অপকর্ম সকলের কাছে প্রকাশ করেন। এর ফলে মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম সহকারি প্রধান শিক্ষক জাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেন (মামলা নং সি আর ১১/২০০০)। তিনি ফিনান্সিয়াল পোস্টকে অনেক অনুসন্ধানী তথ্য দেন। ২০০৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মংলা বন্দরে দুবাই থেকে অবৈধভাবে ২৪ হাজার ২৪০ বোতল অনুমোদনবিহীন বিভিন্ন প্রকার বিদেশি মদ আনায় ২০১১ সালের ৪ জুলাই মংলা থানায় নুরুল ইসলাম সহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক (মংলা থানা মামলা নং ২)। ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর মোহাম্মদ নূরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। ২০১২ সালে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা (পল্টন থানা মামলা নং ৩৩), ২০১৬ সালে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে মামলা (খুলনা থানা মামলা নং ৪৩) ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর রাজধানীর রমনা থানায় দুদকের উপ-পরিচালক এস এম এম আখতার হামিদ ভূঁইয়া বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন (রমনা মডেল থানা মামলা নং ০৪)। দুদকের এ মামলায় অনেকদিন জেল খেটেছেন মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম।
এসকল কারনে মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম ও সহকারী প্রধান শিক্ষক জাহিদুল ইসলাম এর সাথে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে জাহিদুল ইসলামের বিরোধিতা করেন। বর্তমানে সহকারী প্রধান শিক্ষক জাহিদুল ইসলামের সকল একাডেমিক সনদ ঠিক থাকলেও অভিজ্ঞতা সনদের ব্যাপারে প্রশ্ন থাকায় তিনি সেই সনদকে কেন্দ্র করে সহকারী প্রধান শিক্ষক জাহিদুল ইসলামের চাকরির বৈধতার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন।
উত্তর সোনাখালী স্কুল এন্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী ফিনান্সিয়াল পোস্টকে বলেন যদি তার পূর্বের সনদ গ্রহণযোগ্য না হয় তাহা হলে তার পূর্বের অভিজ্ঞতা ও গ্রহণযোগ্য হবে না। যেহেতু সহকারি প্রধান শিক্ষক হতে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে সেহেতু তার অভিজ্ঞতা না থাকলে সহকারি প্রধান শিক্ষক পদে থাকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সহকারি প্রধান শিক্ষক জাহিদুল ইসলামের সনদপত্র বৈধ কিনা তা যথাযথ কর্তৃপক্ষ যাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেয় সেই কামনাই করছি।
উত্তর সোনাখালী স্কুল এন্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটির বর্তমান সভাপতি নজরুল ইসলাম ফিনান্সিয়াল পোস্টকে বলেন, মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম দীর্ঘদিন যাবৎ এই প্রতিষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে ছিলেন এবং সহকারি প্রধান শিক্ষক জাহিদুল ইসলামকে তিনিই নিয়োগ প্রদান করেছেন। তার সীমাহীন দুর্নীতি ও বিভিন্ন কারণে মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম ও জাহিদুল ইসলাম এর মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। যে সনদপত্র নিয়ে অভিযোগ সেই সনদপত্র নিয়ে কোর্টে তার নামে কোন মামলা হয়নি। মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম নিজেকে প্রতিষ্ঠাতা ও দাতা সদস্য দাবি করার বিষয়টি তার কাছে জানতে চাইলেন তিনি বলেন দাতা সদস্য ঠিক আছে কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা কিভাবে দাবি করেন তা আমার বোধগম্য নয়।
মোহাম্মদ নুরুল ইসলামের সাথে জাতীয় ইংরেজি দৈনিক ফিনান্সিয়াল পোষ্টের প্রতিনিধি কথা বললে মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম বলেন, জাহিদুল ইসলাম যে অভিজ্ঞতার বলে চাকুরী নিয়েছেন সেই অভিজ্ঞতাই যদি ঠিক না থাকে তাহলে তার চাকরির বৈধতার ঠিক থাকে কি করে?
তিনি আরো বলেন গত ০১ এপ্রিল ২০২২ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভুয়া সনদে চাকরি করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ শিরোনামে সংবাদ প্রচার হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা অধিদপ্তর নরেচরে বসে। যার ফলে গত ২২ জুন ২০২২ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর তদন্ত শুরু করে এবং গত ৭সেপ্টেম্বর ২০২২ খ্রিস্টাব্দে তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, জাহিদুল ইসলাম ০১ জানুয়ারি ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের সহকারি শিক্ষক (কৃষি) পদে যোগদান কালীন উপস্থাপিত কৃষি শিক্ষা সনদটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়/ ইউজিসি কর্তৃক অনুমোদিত কোন বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কারিগরি শিক্ষা বোর্ড হতে অর্জিত নয়।
এ ব্যাপারে সহকারী শিক্ষক জাহিদুল ইসলামের সাথে জাতীয় ইংরেজি দৈনিক ফিনান্সিয়াল পোস্টের প্রতিনিধি কথা বললে তিনি বলেন, আমি দ্য পিপলস টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছি এবং সেখান থেকে সনদ গ্রহণ করেছি, আমার জানামতে এই প্রতিষ্ঠান সরকার অনুমোদিত বৈধ প্রতিষ্ঠান। এবং উত্তর সোনাখালী স্কুল এন্ড কলেজ এর নিয়োগের সময় আমি এই সনদপত্র দাখিল করিনি যেই প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেছি সেই চাকরির অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছি। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ এর তদন্ত রিপোর্টের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন প্রথমত তদন্ত রিপোর্টে সনদকে অনুপযোগী বলেছে অবৈধ বলেনি তাই আমার বিরুদ্ধে ভুয়া সনদ অর্জনের সংবাদ প্রচার কিভাবে হয়েছে আমার বোধগম্য নয়। দ্বিতীয়ত একজন ছাত্র একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাক্রম শেষ করার দীর্ঘদিন পরে সেই প্রতিষ্ঠানের ব্যপারে অভিযোগ হয় তাহলে সে জন্য ছাত্রদের ক্যারিয়ার কি ধ্বংস করা হবে?
মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম সহকারি প্রধান শিক্ষক জাহিদুল ইসলামের বেতন ভাতা বন্ধের জন্য গত ৩ অক্টোবর ২০২২ খ্রিস্টাব্দে সোনালী ব্যংক আমতলী শাখা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের বিষয়ে সোনালী ব্যংক আমতলী শাখার ম্যানেজার বিশ্বজিৎ চ্যটার্জী বলেন, অভিযোগপত্র পেয়েছি কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পেলে ব্যবস্থা নিতে পারবো তবে সহকারী প্রধান শিক্ষক জাহিদুল ইসলামের ঋণ একাউন্ট থাকায় ঋণের অর্থ বিধি মোতাবেক রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
উত্তর সোনাখালী স্কুল এন্ড কলেজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানান সহকারি প্রধান শিক্ষক জাহিদুল ইসলাম শিক্ষক হিসেবে ভালো হলেও সাবেক সভাপতির সাথে কোন্দলের কারণে এসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। পত্রিকায় শিক্ষকদের নাম প্রকাশের কথা বললে তারা অনুরোধ করে বলেন আমরা এ কথা বলেছি যদি প্রকাশ পায় তাহলে আমাদের স্থানীয়ভাবে সমস্যায় পড়তে হতে পারে তাই শিক্ষকদের নাম প্রকাশ করা গেল না।
এ ব্যপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষাবিদের সাথে কথা বললে তিনি বলেন যেহেতু তার একাডেমিক সনদে কোন প্রকার সমস্যা নেই এবং সে বিগত দিনে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন সেহেতু অভিজ্ঞতা ও আছে, তাই তার এখানে চাকরিতে কোন প্রকার বাধা থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না।
যেখান থেকে আলো আসবে সেখানেই যদি অন্ধকার থাকে তাহলে এই অন্ধকার তারাবে কে? অন্ধকার ঘুচে গিয়ে আলো ছড়িয়ে পড়ুক এমন প্রত্যাশা সর্বস্তরের মানুষের।