বিশেষ সংকেতে ঘুষ নেন গাজীপুর পাসপোর্ট কর্মকর্তারা, হয়রানি চরমে
- হাসিব খান, গাজীপুরঃ
-
২০২২-০৯-২০ ০৫:০০:৫২
- Print
সোমবার সকাল আটটা। পাসপোর্ট নবায়ণ করতে কালীগঞ্জ থেকে গাজীপুরের আঞ্চলিক অফিসে এসেছেন শাহিন-সুমন(ছদ্মনাম) নামে দুই ভাই। বৈধ নিয়মে আবেদন জমা দিলে চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট,বিদুৎ বিলের কপি এবং চাকুরির প্রত্যয়নপত্র না থাকার অজুহাতে বাতিল করা হয়। এক ঘন্টার ব্যবধানে দালালের মাধ্যমে করা একই আবেদন জমা দিলে গ্রহণ করেন পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষ।
আবেদনকারীর ফাইল খতিয়ে দেখা যায়,একই আবেদন। কাগজপত্রে কোন পরিবর্তন নেই। শুধু একটি ¯িøপ এর নিচে বিশেষ সীল চেপে দিয়েছেন দালাল। বিনিময়ে দুটি আবেদনে তাদের দিতে হয়েছে অতিরিক্ত তিন হাজার টাকা। এবার ফাইলটি নিয়ে আবারও লাইনে দাঁড়ান আবেদনকারী। দীর্ঘ দুই ঘন্টা পর সেই একই কর্মকর্তার কাছে গেলে উল্টিয়ে বিশেষ সংকেত দেখে জমা নিয়ে নেন আবেদন। পাসপোর্ট পাড়া ঘুরে এমন জেকে-৩,জেইউ-৩সহ বহু সংকেতের অস্তিত্ব মেলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দালাল চক্রের একজন বলেন,এই অফিসের সামনে ও ভেতরে অন্তত ত্রিশটি চ্যানেল(দালালকে তাদের ভাষায় চ্যানেল বলা হয়) রয়েছে। যারা গাজীপুর পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে এসব সিল সংকেতের মাধ্যমে অবৈধভাবে টাকা কামাচ্ছে। দিনশেষে দালালের করা লিস্টের টাকার একটা বড় অংশ অসাধু কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে দেয়া হয়।
দালাল ছাড়া এমন হয়রানি যেন পাসপোর্ট অফিসের নিত্যদিনের সঙ্গী। অফিসের সামনের গলিতে খুপরির মতো দেখতে সারি সারি দোকান। সাইনবোর্ড দেখে যেকেউ মনে করবে এসব কম্পিউটার-ফটোকপির দোকান। কিন্তু এর আড়ালে ভেতরে ব্যবসা ভিন্ন। প্রকাশ্যে চলছে পাসপোর্ট নিয়ে জাল-জালিয়াতির কারবার। ভুয়া সিল প্যাড ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে যাবতীয় নকল কাগজপত্র। হাত বাড়ালেই মিলছে সব। আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সামনে এসব দোকান ঘর ঘিরেই তৎপর চক্রের সদস্যরা। গত এক সপ্তাহের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। দেখা যায়,বেশিরভাগ পাসপোর্ট প্রত্যাশী ই-পাসপোর্টের ফরম পূরণ করতে গিয়ে দালালের ফাঁদে পড়ছেন। ফরম পূরণ শেষ হলেই দ্রæততম সময়ে পাসপোর্ট করার অফার দেয় দালালরা। পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের জন্য টাকার অংক ভিন্ন। সিরিয়াল ছাড়া আবেদন জমা করতে ৩ থেকে ৫ হাজার,নামের বানান সংশোধনে সর্বনি¤œ ২০ হাজার এবং জন্ম তারিখ সংশোধনে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ পর্যন্ত টাকা চাওয়া হচ্ছে।
পাসপোর্ট অফিসের তথ্য মতে,প্রতিদিন এই আঞ্চলিক অফিসে আবেদন পড়ে ৬থেকে ৭ শো। আর ডেলিভারি দেয়া হয় ৫ থেকে ৬ শোর মতো পাসপোর্ট। ক্যাটাগরি বিবেচনায় সর্বনি¤œ ৪ হাজার ২৫ টাকা থেকে ৮ হাজার ৫০ টাকায় পাসপোর্ট করার সরকারি নিয়ম রয়েছে। তবে সরকারি এ নিয়মের কোন তোয়াক্কা চলে না এই অফিসে।পাসপোর্টের আরেক দালাল বলেন,‘অফিসে তাদের লোক আছে। পাসপোর্ট আবেদনে তাদের দেওয়া সিল থাকলে আবেদন নিয়ে আর কোন ঝাঁমেলা পোহাতে হয়না। দিনশেষে নামের হিসেব করে অফিসের অসাধু কর্মকর্তাকে পৌছে দেওয়া হয় ঘুষের টাকা। পাসপোর্ট দালালির কাজে তাদের প্রত্যেকের গড়ে দৈনিক আয় হয় ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া পাসপোর্টের ‘বড় কাজ’ পেলে তো কপাল খুলে যায়।
গাজীপুর পাসপোর্ট অফিসের পাশে এমন অর্ধ-শতাধিক দোকানে দিনভর চলছে আজব এই ঘুষ কমিশন ও জালজালিয়াতির কারবার। বেশিরভাগ দোকানে লোক দেখানোর জন্য রাখা আছে কম্পিউটার এবং ফটোকপি মেশিন। সারাক্ষণ এখানে দালালদের প্রকাশ্য হাঁকডাক। কোনো আবেদনকারী সামনে এলেই তারা বলে উঠেন, ‘কী কাজ ভাই? আসেন, বসেন। করে দিব। কম লাগবে। প্রধান কম্পিউটার,কালিগঞ্জ কম্পিউটার,মা কম্পিউটার,ফরিদ কম্পিউটার,মায়ের দোয়া স্টুডিও নামের বিভিন্ন দোকানে দালালদের যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। দেখা যায়, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ পাসপোর্ট সংক্রান্ত বহুবিধ সমস্যা নিয়ে দালালের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এদের একটি বড় অংশ পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে সমাধান পাননি অথবা চরম হয়রানির শিকার হয়েছেন। সাকিব হোসেন নামের এক ছাত্র জানান,তার বাবার নামের একটি সংশোধনের আবেদন করেছেন চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে। কিন্তু দীর্ঘ ছয় মাসেও এর কোন সমাধান পায়নি। অফিসে গেলে বিভিন্ন সমস্যা দেখিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এই পাসপোর্টের জন্য বাবাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে পারছি না। এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি চান শিক্ষার্থীসহ গ্রাহকরা।
সার্বিক বিষয়ে গাজীপুর পাসপোর্ট অফিসের আঞ্চলিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন,সংকেতের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হয় এমন কোন অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। তবে জনবলের সংকট রয়েছে। আমরা যে পরিমাণ আবেদন গ্রহণ করতে পারি, তার থেকে অনেক বেশি আবেদন আসে যার ফলে আমাদের হিমসিম খেতে হচ্ছে। দালালের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,অফিসের বাহিরে বিভিন্ন কম্পিউটারের দোকান রয়েছে। সেখানে কেউ যদি ফরম পূরণ করতে যেয়ে দালালের শিকার হন বিষয়টি আমাকে বলতে হবে। আর বিশেষ সংকেতের বিষয়টি আগে আমাকে কেউ জানায়নি। আপনি জানিয়েছেন আমি জেলা প্রশাসককে জানিয়ে অভিযানের ব্যবস্থা করবো।
পাসপোর্ট অফিসে হয়রানী ও নানা অনিয়মের ব্যাপারে গাজীপুর জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, সরকারি সেবার ব্যতয় ঘটলে,অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।