কুড়িগ্রামে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে জেলা ও নাগেশ্বরী উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগ আর মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতির চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নারী উদ্যোক্তাদের যুব সংগঠনের মাধ্যমে কর্ম দক্ষতায় কর্মসংস্থানে নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী, ফুলবাড়ী উপজেলাসহ কচাকাটা থানায় কমে আসছে বাল্য বিবাহের সংখ্যা।
সরেজমিনে জানা গেছে, মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতির চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের মাঠকর্মী ও ইউনিয়ন পর্যায়ে যুব সংগঠন করে ইউসির মাধ্যমে চরাঞ্চল গ্রাম শহরে সচেতনতা-মূলক প্রচার-প্রচারণা ও নিয়মিত বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ কর্মশালায় প্রতিনিয়ত রোধ হচ্ছে বাল্য বিবাহ। অসচ্ছল নারী শিক্ষার্থীদের করছেন আর্থিক সহযোগিতা এমজেএসকেএসের চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্প। ফলে বাল্য বিবাহের হার নেমে আসছে শূন্যের কোঠায়। অপরদিকে নাগেশ্বরীর নেওয়াশী ইউনিয়ন: নাগেশ্বরী উপজেলার নেওয়াশী ইউনিয়নের হাজীপাড়া গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্ম মোরশেদা খাতুনের। ২০২১সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনার সময় মোরশেদার বাবা মোশারফ হোসেন মানসিক রোগে অসুস্থ হয় মারা গেলে বিয়ে দিতে চেয়েছিল তার পরিবার। কিন্তু মোরশেদা খাতুন কোনোমতেই পরিবারের মত মেনে নিতে পারেননি। তাই নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকাতে বজলার রহমান আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও তার মামা আখলাছ হোসেন এবং এমজেএসকেএসের চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের সহায়তায় স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রী মোরশেদা এখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। মোরশেদা খাতুনের পরিবারে তার এক ভাই আয়ান বাবু শিশু শ্রেণিতে পড়ছেন আর তার মা আর্জিনা বেগম স্বামী হারানোর শোকে অসুস্থ। মোরশেদা লেখাপড়া করে আদর্শবান ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বুনঝেন এবং এলাকার মানুষের সেবা করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পাশাপাশি মোরশেদা এমজেএসকেএসের চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের নেওয়াশী ইউপি ইউসির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে মফস্বল অঞ্চলে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে যুব সংগঠন করে সেখানে নিয়মিত সচেতনতা-মূলক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে বাল্য বিবাহ রোধ করাসহ অসচ্ছল নারী শিক্ষার্থীদের করছেন আর্থিক সহযোগিতা। মোরশেদা খাতুন বলেন, আর্থিক দুরবস্থার কারণে বিয়ে দেয়া সব সমস্যার সমাধান নয় বরং বাল্য বিবাহের কারণে আমাদের দেশে হাজারো মেয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় এবং একপর্যায়ে অপমৃত্যুর শিকার হয়। এমজেএসকেএসের চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের নেওয়াশী ইউপি ইউসির দায়িত্বে থেকে অনেক বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করেছি।
নাগেশ্বরী পৌরসভা: নাগেশ্বরী শহরের হাজীপাড়া মহল্লার বাসিন্দা পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শামছুল আলমের কন্যা ও নাগেশ্বরী ডিএম একাডেমীর দশম শ্রেণির ছাত্রী শারমিন আক্তার শান্ত্বনা সে নিজের বাল্য বিবাহ নিজেই রোধ করে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে সে লেখাপড়া করে আদর্শবান পুলিশ অফিসার হওয়ার স্বপ্ন বুনঝেন। পাশাপাশি নাগেশ্বরী সদরের সাজিয়া খাতুন, কনিকা রাণী, ইয়াসমিন খাতুন, অঞ্জলি রাণী, বৈশাখী রাণী মোহন্ত, আয়শা সিদ্দিকা, অচিন অর্পিতা, মাহমুদা আক্তার ইতি ও শাম্মী আক্তার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারা নিজের বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করে এবং মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতির চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের অধীনে বাল্য বিবাহ রোধে কমিটি গঠন করে আলোচনার মধ্য দিয়ে বাল্য বিবাহ রোধ করে অন্যান্য ভুমিকা রাখছেন।
নাগেশ্বরীর বামনডাঙ্গা ইউনিয়ন: নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের আদর্শবাজার এলাকার হাবিবুল্ল্যাহ মিয়ার কন্যা কল্পনা খাতুন অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনার সময় দুধকুমার নদী ভাঙনে তাদের বাড়িঘর ও সবকিছু হারিয়ে তার বাবা মেয়ে কে বাল্য বিবাহ বিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কল্পনা কোনোমতেই পরিবারের মত মেনে নিতে পারেননি। তাই নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকাতে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও তার মা মমেনা বেগম এবং এমজেএসকেএসের চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের সহায়তায় কল্পনা আজ অনার্স প্রথম বর্ষের মেধাবী ছাত্রী এবং সে লেখাপড়া করে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। পাশাপাশি কল্পনা এমজেএসকেএসের চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের ইউসির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে চরাঞ্চলে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে যুব সংগঠন করে সেখানে নিয়মিত সচেতনতা-মূলক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে বাল্য বিবাহ রোধ করাসহ অসচ্ছল নারী শিক্ষার্থীদের করছেন আর্থিক সহযোগিতা।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর বড়ভিটা ইউনিয়ন: হাতে প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন, কন্ঠে স্লোগান নিয়ে বাল্য বিবাহ রোধে ফুলবাড়ী উপজেলার এক সংগ্রামী তরুনি মিষ্টি খাতুন। সে শাহবাজার ফাজিল মাদ্রাসার কামিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী এবং বড়ভিটা ইউনিয়নের পশ্চিম ধনীরাম গ্রাামের দিনমজুর ও ভূমিহীন নবির উদ্দিনের মেয়ে। প্রতিদিন শ্রম বিক্রি করে নবির উদ্দিনের যা আয় হয় তাই দিয়ে চলতে হয় ৫জন সদস্যের সংসার। দারিদ্র্যের কাছে হার মেনে তার দুই মেয়েকে বাল্য বিবাহ বিয়ে দিয়েছেন। এর এক পর্যায়ে তৃতীয় মেয়ে মিষ্টি খাতুন কেও বিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তার বাবা। কিন্তু মিষ্টি খাতুন তার দুই বোনের বাল্য বিবাহের পরবর্তী দূর্বিষহ জীবন দেখে বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন হয়ে পিতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং সে রুখে দাঁড়ায় তার পরিবারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। মিষ্টি খাতুন লেখাপড়া করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করতে একা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। মিষ্টি খাতুনের জীবন সংগ্রামের কথা জানতে পারে মহিদেব যুব সমাজকল্যান সমিতি সিএনবি প্রকল্পের ফুলবাড়ী উপজেলার ফিল্ড ফ্যাসিলেটর জাহিদুল ইসলাম। তিনি মিষ্টি খাতুনের বাল্য বিবাহ রোধে সংগ্রামের সহযোগী হিসেবে তাকে তার গ্রুপের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে ও তাকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। মিষ্টি খাতুন নতুন উদ্যমে অনুপ্রানিত হয়ে গ্রামের মেয়েদের নিয়ে বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে বাড়ি বাড়ি প্রচারণা শুর করে এবং সেই সাথে সে বিভিন্ন রকম প্ল্যাকার্ড, ফেষ্টুন, ব্যানার নিয়ে গণ সংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। তার এই উদ্যোগে অনেক মেয়েই বাল্য বিবাহের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে। মিষ্টি খাতুন, জানান, কুড়িগ্রাম জেলা বাংলাদেশের দরিদ্রতম জেলা। এই জেলার বাল্য বিবাহের হার অনেক বেশী। বাল্য বিবাহের ফলে মেয়েদের শিক্ষা থেকে বহচ্ছেন। সে ভবিষ্যতে একজন সেবিকা হয়ে চিকিৎসা ক্ষেত্রের উন্নয়নে ভুমিকা রাখতে চায়। মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতির চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের ফুলবাড়ী উপজেলার ফিল্ড ফ্যাসিলেটর জাহিদুল ইসলাম জানান, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় মেয়েরা শিক্ষাজীবন অসম্পূর্ণ রেখে সংসার জীবনে প্রবেশ করে। ফলে তারা আর্থিক স্বাধীনতা ও সামাজিক ক্ষমতায়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। কম বয়সে গর্ভধারণের কারণে মেয়েদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মাতৃমৃত্যু ও নবজাতক মৃত্যুর ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়।
এমজেএসকেএসের চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের প্রোজেক্ট কো-অডিনেটর মাহমুদুল হাসান, বলেন, চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন অঞ্চলে যুব সংগঠন করে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করা হচ্ছে। মেধাবী ছাত্রীদের কর্মের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতাও করা হচ্ছে। মোরশেদার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো।