মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন পুলিশের নির্যাতনে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড হত্যায় বিক্ষোভের দাবানল জ্বলছে ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশে একই কায়দায় একটি হত্যা ও একটি নির্যাতন দেখে আমরা শিউরে উঠেছি। দুই দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন নিঃসন্দেহে কিন্তু দৃশ্যপট প্রায় একইরকম। পুলিশ জর্জ ফ্লয়েডকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে হত্যা করে, ঘাড় চাপা দেওয়ায় তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। অনেক কাকুতি-মিনতি করে ফ্লয়েড মৃত্যুকালে বলেছিলেন- আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। তার সমবেদনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কীভাবে এ আকুতি ছড়িয়ে পড়ে তা আমরা দেখেছি।
বাংলাদেশে এ মাসের শুরুর দিকে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় কৃষক নিখিল তালুকদারকে নির্মমভাবে হত্যা করে পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক শামীম হাসান। পিঠের শিরদাঁড়া হাঁটু দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে ভেঙে দিলে নিখিলের মৃত্যু ঘটে। ইতোমধ্যে ওই উপপরিদর্শক ও পুলিশের 'তথ্যদাতা' মো. রেজাউল আটক হয়েছে বটে, প্রশ্ন হলো কীভাবে এমন নির্মম নির্যাতন চালানো সম্ভব। এমনকি তেমন কোনো গুরুতর অভিযোগে নিখিলের সঙ্গে নির্দয় আচরণ করা হয়নি; তাস খেলার সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে যখন চারজন পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন নিখিল তালুকদার ধরা পড়লে পুলিশের ওই উপপরিদর্শক তাকে মারধরের পাশাপাশি হাঁটু দিয়ে পিঠে ও মেরুদে আঘাত করে। অপরাধ গুরুতর কিংবা লঘুতর যা-ই হোক আইনরক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে কী?
লালমনিরহাটের ঘটনা আরও গুরুতর। বৃহস্পতিবার সমকালের প্রথম পাতায় 'কিশোরকে নির্মম নির্যাতন' শিরোনামের প্রতিবেদনে আমরা দেখছি, চুরির অভিযোগে কিশোরকে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে মুখ ও গলা চেপে ধরে এক ব্যবসায়ী। বাঁচার জন্য মমিনুল ইসলাম নামে ওই কিশোর অনেকের পা জড়িয়ে ধরে কাকুতি-মিনতি করলেও কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। এ ঘটনায় কিশোরটি মারা না গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ফ্লয়েড কিংবা গোপালগঞ্জের নিখিল তালুকদারের কায়দায় যে নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা অমানবিক। নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি, ব্যবসায়ী তা ভিডিওতে ধারণও করেছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা পোস্ট করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। এ ঘটনায় ব্যবসায়ী আশরাফ আলী ও তার দুই সহযোগীকে অবশ্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মানসিকতা কতটা অসুস্থ হলে এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত করা সম্ভব। আমরা মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের ওই পুলিশের বর্ণবাদী মানসিকতার সঙ্গে যারা এ ধরনের অপরাধ করছে তাদের মানসিকতার তাৎপর্যপূর্ণ কোনো পার্থক্য নেই। পুলিশের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। এ সেবাকর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যের এটা চিন্তা করার কারণ নেই যে তিনি সাধারণ নাগরিকের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। একইসঙ্গে যারা শিশু-কিশোরদের নির্যাতন করে, তাদেরও এটা ভাবা অন্যায় যে, ছোট বলে তাদের সঙ্গে যা ইচ্ছা তা করতে পারবে।
এমনিতেই এক দুর্যোগে আমরা বিপর্যস্ত। আজ পুরো বিশ্বই ভয়াবহ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যখন করোনা ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে একই সমতলে নিয়ে এসেছে, আর এ দুর্যোগ মোকাবিলায় এক হয়ে পরস্পরের প্রয়োজনে সবাই পাশে দাঁড়াচ্ছে। এমনকি সৃষ্টি করছে নানা মানবিক দৃষ্টান্ত। ঠিক এ সময়ে এমন অমানবিক আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর আগেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য দ্বারা সাধারণ মানুষের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। আবার কিশোর রাকিব, রাজনের ওপর 'সমাজের' নির্মম নির্যাতনের ঘটনাও আমাদের সামনে এসেছে। আমরা চাই এসব ক্ষেত্রে অপরাধী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। একটি মানবিক সমাজ নিশ্চিতে এর বিকল্প নেই।