হজরত মুসা আ:-এর জমানায় কারুন নামে একজন খুব ধনী লোক ছিল। নিজের সীমাহীন কৃপণতা এবং ধন লোভের জন্য পৃথিবীর যেকোনো নিকৃষ্ট পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে কারুনের যে ‘দক্ষতা’ ছিল তার সাথে সমসাময়িক দুনিয়ায় অন্য কারো তুলনা চলে না। ফলে মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে মন্দ লোকের তালিকায় সে যেভাবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে, তা অতিক্রম করার কথা অতীতকালে কেউ কল্পনা করেনি। কিন্তু ২০২০ সালের করোনা সঙ্কটের সময় কিছু নব্য কারুনের আবির্ভাব বাংলাদেশে হয়েছে যারা হজরত মুসা আ:-এর জমানার কারুনকে ভারি লজ্জার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
মন্দ লোকদের কোনো জাতপাত নেই। তাদের কুকর্মের সীমা-পরিসীমা যে কতটা ভয়ঙ্কর আর নিকৃষ্ট মানের হতে পারে তা মনুষ্য মস্তিষ্ক তো দূরের কথা স্বয়ং ইবলিসও কল্পনা করতে অক্ষম। শ্মশান বা কবরস্থান থেকে লাশ চুরি, শত্রুর মুখে এসিড নিক্ষেপ, শিশুধর্ষণ, মা-বাবাকে সম্পত্তির লোভে খুন করা অথবা বার্ধক্যকালে কিংবা অসুস্থতার সময় বৃদ্ধ মা-বাবাকে রাস্তায় ফেলে দেয়ার মতো নির্মম কুকর্ম কারুন নামক পাষণ্ড করত কি না জানি না; কিন্তু কারুনের ডিজিটাল মানবপুত্র বা কন্যারা যে বাংলাদেশে ওসব কুকর্ম দেদার করছে তা বোধ করি এই দেশের সবাই কমবেশি জানেন।
Ad by Valueimpression
আমাদের দেশের কারুনরা পাকিস্তান আমলে কেমন ছিল এবং মুক্তিযুদ্ধকালে তারা কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল তা রীতিমতো ইতিহাস হয়ে রয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে ১৯৭২-৭৫ সাল অবধি মন্দ মানুষের যে হাট বসত এবং এসব হাটে যেভাবে মন্দ কাজের প্রকাশ্যে নিলাম উঠত তা দেখে সভ্য দুনিয়ার লোকজন রীতিমতো হতবাক হয়ে যেত। পরবর্তীকালে মন্দ মানুষরা বৈধভাবে-অবৈধভাবে এবং গোপনে অথবা প্রকাশ্যে যেভাবে প্রজনন ঘটিয়ে নিজেদের বংশ বৃদ্ধি ঘটিয়েছে তাতে তাদের স্বভাবগুলো বিকৃত হতে হতে কাউয়া বা হাইব্রিড মুরগির স্তরে নেমে এসেছে। তারা কাউয়ার মতো সর্বভুক পাখি হিসেবে যেমন বিরক্তিকর তেমনি হাইব্রিড মুরগির মতো নিজেদের দেহখানা এমনভাবে গড়ে তোলে যাতে তাদের মালিকরা সময়ে-অসময়ে তাদের জবাই করে জিয়াফতের আয়োজন অথবা তাদের বলি দিয়ে প্রতিপক্ষের মুখ বন্ধ করতে পারে।
বর্তমান সময়ের ডিজিটাল কারুনদের তাণ্ডব যদি বুঝতে হয় তবে আদি ও আসল কারুনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছু ধারণা লাভ করা দরকার। প্রায় তিন হাজার ৩০০ বছর আগে মিসর দেশে খুবই নামকরা একজন ফেরাউন ছিলেন। দ্বিতীয় রামেসিস নামে তিনি পুরো এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শাসন করতেন। তার রাজধানীতে বিশেষত দুই শ্রেণীর জনগোষ্ঠী ছিল। যারা মিসরের আদি বাসিন্দা ছিলেন তাদের বলা হতো ‘কিবতি’। অন্য দিকে হজরত ইউসুফ আ:-এর জমানায় তার আত্মীয়-স্বজন ও বংশীয় লোকরা যারা হিজরত করে মিসরে চলে এসেছিলেন; তাদের বলা হতো বনি ইসরাইল। হজরত ইউসুফ আ:-এর বাবার নাম ছিল হজরত ইয়াকুব আ:; যার অন্য নাম ছিল ‘ইসরাইল’। মূলত হজরত ইয়াকুব আ:-এর বংশধররাই বনি ইসরাইল নামে জগৎজোড়া পরিচিতি পেয়েছে।
আসমানি কিতাবগুলোতে বনি ইসরাইল জাতি সম্পর্কে যে বর্ণনা রয়েছে তা থেকে জানা যায়, এই জাতিটির প্রতি আল্লাহর রহমত-বরকত ও নেয়ামত ছিল অফুরন্ত। ধন-সম্পদ, রাষ্ট্রক্ষমতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং নবী-রাসূলদের মাধ্যমে ঐশী দিকনির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জাতিটিকে নজিরবিহীন সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু তারা সর্বদাই আল্লাহর অবাধ্যতা, নাশোকরি এবং জমিনে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টির মাধ্যমে বহুবার আসমানি গজবের কবলে পড়েছে এবং সীমাহীন দুর্ভোগ-দুর্দশা ও অপমানের কবলে পড়ে মানবেতর জীবনে বাধ্য হয়েছে।
ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিসের জমানায় বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের প্রায় ১২ লাখ লোক মিসরের রাজধানী এবং এর আশপাশের এলাকায় বাস করত। ওদের বেশির ভাগ লোকই ছিল মিসরীয় ভূমিপুত্র কিবতিদের ক্রীতদাস বা ক্রীতদাসী, যারা শত শত বছর ধরে ক্রমাগতভাবে নির্যাতিত হয়ে আসছিল তাদের পূর্বপুরুষদের নাফরমানির দায় শোধ করার জন্য। তাদের দুর্ভোগ-দুর্দশার মাত্রা যখন চরমে পৌঁছল তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের রহমতের দরিয়ায় জোয়ার এলো। তিনি বনি ইসরাইলদের উদ্ধারের জন্য হজরত মুসা আ: ও তার ভাই হজরত হারুন আ:কে নবীরূপে মনোনীত করলেন এবং বিশেষ কিছু অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিসের দরবারে পাঠালেন। পবিত্র কুরআন এবং খ্রিষ্টানদের বাইবেলসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে প্রায় সমভাবে হজরত মুসা আ:-এর কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা আজকের আলোচনায় সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোকপাত না করে হজরত মুসা আ:-এর নিকটাত্মীয় এবং বনি ইসরাইলিদের অন্যতম সরদার কুখ্যাত কারুন প্রসঙ্গে চলে যাই।
ইসলামী পরিভাষায় আমরা যাকে কারুন বলে অভিহিত করি, পশ্চিমা দুনিয়া তাকে কোরাহ বলে জানে, যার পিতার নাম ছিল ইজাহার। আবার ইজাহারের বাবার নাম ছিল কোহাথ এবং দাদা ছিলেন লেভি, যারা সবাই বংশপরম্পরায় ইসরাইল সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। কারুনের দুইজন ভাই ছিল যথাক্রমে নিফেগ এবং জিরছি নামে। বাইবেলের বর্ণনা মতে, ইজাহার ছিলেন হজরত মুসা আ:-এর চাচা অথবা মামা কিংবা ফুফা। সে অর্থে হজরত মুসা আ:, তাঁর ভাই হজরত হারুন আ: এবং তাদের বড় বোন মরিয়মের সাথে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়তার বন্ধন ছিল কারুনের।
আগেই বলেছি, কারুন তৎকালীন মিসরে অতিশয় ধনী ও প্রভাবশালী লোক বলে পরিচিত ছিল। ফেরাউনের দরবারেও সে মন্ত্রীর মর্যাদায় অভিহিত হতো। ফলে ধারণা করছি যে, জন্মগতভাবে ক্রীতদাস হওয়া সত্ত্বেও কারুন হয়তো ফেরাউনের বিশেষ অনুমতিতে স্বাধীন নাগরিকের মতো চলাফেরা করত এবং ধনসম্পদ ধারণ করার আইনি সুযোগ লাভ করেছিল। আমি আরো ধারণা করছি, কারুণ দাস ব্যবসা, সুদের কারবার এবং নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থ ফেরাউনের কাছে জলাঞ্জলি দেয়ার কাজও করত। ফলে সে ফেরাউনের এজেন্টরূপে বনি ইসরাইলিদের যাবতীয় স্বার্থ, মান-মর্যাদা এবং ইজ্জত নিয়ে ভয়াবহ আর জঘন্য ব্যবসায় লিপ্ত থেকেই হয়তো অঢেল অর্থকড়ির মালিক হয়েছিল।
হজরত মুসা আ: যখন নিজের সম্প্রদায়ের লোকজন নিয়ে মিসর ত্যাগ করেন তখন তার সাথে কারুনও তার লোকজন এবং ধনসম্পদ নিয়ে রওনা দেয়। ইচ্ছে করলে মিসরে থেকে যেতে পারত কিন্তু সেটি করেনি। কারণ তার ব্যবসাবাণিজ্য ছিল মূলত বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের ১২ লাখ বাসিন্দাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং সে যদি মিসরে থেকে যেত তবে রাজধানীতে তার গুরুত্ব থাকত না। দ্বিতীয়ত, স্বজাতীয় লাখ লাখ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সে যেভাবে রাজসিকতা নিয়ে চলাফেরা করত এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখাত- তা বনি ইসরাইলশূন্য মিসরে সম্ভবপর ছিল না। তৃতীয়ত, হজরত মুসা আ:-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, বনি ইসরাইলিদের বিপথে পরচালিত করা, তাদের মধ্যে ফেরাউনের সপক্ষে গুণগান চালু রাখা এবং সুযোগ বুঝে তাদের পুনরায় মিসরে ফিরিয়ে নেয়ার নীলনকশা বাস্তবায়ন করার জন্যই হয়তো কারুন হজরত মুসা আ:-এর সাথী হয়েছিল।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কারুন তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে একাধিকবার হজরত মুসা আ:-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। বনি ইসরাইলিদের গোবৎস পূজায় উদ্বুদ্ধ করা এবং মিসরে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে ফিতনা-ফাসাদ আরম্ভ করেছিল। সে অত্যন্ত সুকৌশলে হজরত মুসা আ: ও হজরত হারুন আ:-এর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল এবং লোকজনকে আল্লাহ আর তাঁর নবীদের বিরুদ্ধে সন্দিহান করে তুলেছিল। সবশেষে সে হজরত মুসা আ:-এর ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটনা করেছিল; ফলে হজরত মুসা আ: যারপরনাই মনোকষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি আল্লাহর দরবারে কারুনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য প্রার্থনা করেছিলেন এবং আল্লাহর হুকুমে কারুন বনি ইসরাইলিদের চোখের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে ধীরে ধীরে জমিনের অভ্যন্তরে এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিল, যা দেখে সবার মনে হচ্ছিল, আল্লাহর জমিন কারুনকে গিলে খাচ্ছে।
কারুন সম্পর্কে এই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে আমরা যদি চলমান করোনা সঙ্কটকালে বাংলাদেশের কিছু লোভী মানুষের সীমাহীন ধনলিপ্সা, অসহায় মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়ার অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতা এবং মৃত্যুপথযাত্রী করোনা রোগীকে কবর অথবা শ্মশানে ঠেলে দিয়ে টাকা কামানোর ধান্ধার সাথে তুলনা করি তবে মনে হয় বর্তমান জমানার কারুনের প্রেতাত্মাদের সাথে প্রতিযোগিতা শুরু হলে আদি ও আসল কারুন ‘নাবালক’ হিসেবে গণ্য হবে এবং বর্তমানকালে তার বংশধরদের দৌরাত্ম্য দেখে হয়তো আত্মহত্যা করে ভবলীলা সাঙ্গ করবে।
একটা মানুষরূপী প্রাণী কত বেশি নিষ্ঠুর পাশবিক জন্তু হতে পারে তা যদি আপনি অনুধাবন করতে চান তবে করোনা সংক্রান্ত নকল ওষুধ উৎপাদনকারী-বিপণনকারীদের দেখে আসতে পারেন। আপনি নকল মাস্ক, নকল স্যানিটাইজার এবং নকল চিকিৎসার সাথে জড়িত লোকজনের মধ্যেও ভয়ঙ্কর এক কারুনের দেখা পেয়ে যাবেন। জাতির এই সঙ্কট মুহূর্তে রাজকোষে জনগণের যে টাকা জমা রয়েছে সেই টাকায় ভাগ বসানোর জন্য যারা লোভের জিহ্বা প্রসারিত করেছে তারা যে কারুনের চেয়েও নির্মম ও নিষ্ঠুর তা দিব্যি করে বলতে পারি। সরকার যেসব প্রণোদনা দিচ্ছে বা ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছে সেগুলো যারা আত্মসাৎ করছে তারা কোন পর্যায়ের প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত, তা আমার মন-মস্তিষ্কে ঢুকছে না।
দেশের চলমান করোনা সঙ্কটে যেভাবে কিছু মানুষ অমানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় দৌড়াদৌড়ি করছে তা দেখে শান্তিপ্রিয় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। কারণ- মানুষের কুকর্মের কারণে যেমন বালা-মুসিবত আসে, তেমনি কুকর্মকারীদের তওবার ফলেই সেসব বালা-মুসিবত বিলীন হয়ে যায়। ইতিহাসের এই চিরন্তন অমিয় বাণীর প্রেক্ষাপটে আমরা যদি ২০২০ সালের জুন মাসের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করি তবে চলমান সঙ্কট সৃষ্টিতে স্রষ্টাকে দায়ী করার জন্য একজন নির্বোধ ও পাগলও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য