উন্নয়ন কাজের দোহাই দিয়ে পায়রা বন্দর সংলগ্ন রাবনাবাদ নদীসহ পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন নদ-নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে অসাধু চক্র। এতে বিঘ্নিত হচ্ছে ইলিশের অবাধ প্রজনন, হুমকিতে রয়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র। ভেস্তে যেতে বসেছে মা ইলিশ সংরক্ষন কার্যক্রম।
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রশাসনের দেওয়া আড় ভেঙে বালু আনা নেওয়া করছে বালু খেকোরা। কোন বাধাই মানছে না বেপরোয়া বালু ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয় প্রভাবশালীদের দাপটে প্রতিনিয়ত কলাপাড়া দেবপুর রাবনাবাদ নদী থেকে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে নদী। ফলে বাড়ছে নদী ভাঙ্গনের দৃশ্য, গৃহহীন হয়ে পড়েছে নদীর পাড়ের বাসিন্দারা। নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বেরিবাঁধ ও ব্রীজ। এদিকে প্রভাবশালীদের ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারছেনা ভুক্তভোগী মৎস্যজীবী ও এলাকাবাসীরা। স্থানীয় পর্যায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পটুয়াখালীর কলাপাড়া দেবপুর রামনাবাধ নদী থেকে নিয়মিত অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এরা কাউকে তোয়াক্কা না করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ লোক তো দুরের কথা প্রশাসনও অনেক সময় এদের বাধা দিতে হিমসিম খাচ্ছে। অবৈধ বালি বিক্রির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার জন্য মেসার্স বাপ্পী এন্টারপ্রাইজ ও ইজারাদার চরমালিকগন মেসার্স অন্য এন্টারপ্রাইজ উক্ত বিষয়ে জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেন।
১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। এসময় ডিম ছাড়ার জন্য সাগর থেকে বিভিন্ন নদ নদীতে ছুটে আসে ইলিশের ঝাঁক। নদীর পানিতে নিশিক্ত হয়ে ডিম রুপ নেয় জাটকায়। এমন ভাবেই ঘটে ইলিশের বংশবিস্তার। মা ইলিশ সংরক্ষন মৌসুমে প্রজননে যেন কোন ধরনের ব্যাঘাত না ঘটে তাই নদীতে ড্রেজিং ও বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনকে ব্যাবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটি। এদিকে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাতের আঁধারে নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে বালু খেকোরা। নদীর মাঝখানে নোঙ্গর করে রাখা ড্রেজার, চলাচলরত বালু পরিবহনকারী বাল্বহেড জাহাজ ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বালু ফেলা এর প্রমাণ বহন করে।
অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে জেলে ও নদীতীরে বসবাসরত মানুষেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চম্পাপুর ইউনিয়নের একাধিক বাসিন্দা বলেন, রাত দিন নির্বিচারে নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তারা বাঁধা দিতে গেলে রাজনৈতিক নেতাদের হুমকির শিকার হন। বালু উত্তোলনের ফলে নদীর তীর ভাঙছে বলে জানান তারা। তারা আরো বলেন, বর্তমানে মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের অবরোধ চলছে জেলেরা মাছ ধরছেনা যাতে ইলিশ ডিম ছাড়তে পারে। কিন্তু এই সময় ড্রেজার চাললে বালুর সাথে মাছের ডিমও চলে যাবে তাতে জেলে সহ দেশেরও অনেক ক্ষতি হবে।
কথা হয় রাবনাবাদ নদীতে নোঙ্গর করা লোড ড্রেজার বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী রবিউল ও রাহাত হোসেনের সাথে তারা প্রতিবেদককে জানান, গত ২/৩ মাস ধরে তারা এই নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে বালু উত্তোলন করছেন। তাদের কোম্পানীর নির্দশনা অনুযায়ী তারা বালু উত্তোলন করেন। প্রতিদিন ২/৩ টি বাল্কহেড পূর্ণ করে দেন তারা। এপর্যন্ত ৩/৪ লক্ষ ঘনফুট বালু উত্তোলন করার কথা জানান তারা।
লোড ড্রেজার রাইয়ান এন্টারপ্রাইজের চালক মোঃ আঃ রহিম বলেন, একমাস আগে তিনি এখানে এসেছেন প্রতিদিন দু এক বাল্কহেড বালু তোলেন তারা। কোন কাগজ পত্র আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন সেটা কোম্পানী জানে তাদের এখানে বালু কাটতে বলেছে তাই তারা কাটছেন।
এ বিষয়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের এ্যাকুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ লোকমান আলী বলেন, ইলিশের প্রজননকালীন সময়ে ড্রেজার বন্ধ রাখা খুবই জরুরী কারন হলো ইলিশ মাছ নদীতে যখন ডিম ছাড়ে, ডিম পানিতে মিশে যায় এসময় ড্রেজার চালানো হলে পানি ও বালুর সাথে অনেক ডিম উঠে আসবে এবং অনেক ডিম ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এছাড়া মা ইলিশ যখন ডিম ছাড়বে ড্রেজারের শব্দে তাদের নদীতে মুভমেন্ট করার সময় বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। তাই ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে এই সময় ড্রেজার বন্ধ রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের ডিন ড.মোঃ নুরুল আমিন বলেন, অপরিকল্পিত ভাবে বালু উত্তোলন করা হলে নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা বৃদ্ধি পাবে ফলে নদী তীরে ভাঙ্গন সৃস্টি হওয়ার পাশাপাশি গতিপথ পরিবর্তনের সম্ভাবনা বাড়বে। এছাড়া নদীগর্ভে যেসকল হেভি মেটাল রযেছে তা পানিতে মিশবে এবং অক্সিজেনের ঘাটতি হবে এতে বায়োডাইভারসিটি বিনষ্ট হবে। মাছের উৎপাদন কমে যাবে এবং পানিবাহিত রোগ বৃদ্ধি পাবে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ কামরুল ইসলাম বলেন, ইলিশের অবাধ প্রজনন নিশ্চিত করতে এ সময় নদ নদীতে সকল ধরনের ড্রেজিং বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাস্কফোর্স কমিটি। এ ব্যাপারে সকল স্টেকহোল্ডারগণকে অবহিত করা হয়েছে তবুও যদি রাতের আঁধারে কেউ এমন কাজ করে থাকে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে আমরা জেলা প্রশাসনকে অবহিত করব।
এ বিষয়ে লোড ড্রেজার মেসার্স বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের মোঃ রব মুঠোফোনে প্রতিবেদককে জানান, অবরোধের সময় বালু উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা থাকার বিষয়টি তিনি জানতেন না। ভুল করে তাদের লোকজন ড্রেজিং করেছেন সামনের দিকে ড্রেজিং না করার কথা জানান তিনি।
এ বিষয়ে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, মা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম চলাকালে নদ নদীতে অনুমোদিত ড্রেজিং করাও নিষিদ্ধ। ইতিমধ্যে বিষয়টি সকলকে অবহিত করা হয়েছে। আমাদের টহল অব্যাহত আছে কেউ যদি নির্দেশনা অমান্য করে ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করে তাহলে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে আমরা কাউকে ছাড় দেবো না ।