সাধারণত প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কর্মরতরা রুটিন অনুযায়ী কাজ করে থাকেন। তাদের মধ্যে সবসময় কর্তৃত্বসূলভ মনোভাব কাজ করে। ফলে কর্মস্থলের বাইরে অন্যকোথাও তারা নিজেদের সহজে মানিয়ে নিতে পারেন না।
অন্যদিকে বৈজ্ঞানিকদের কাজের রুটিন তাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। গবেষণার পেছনে রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় তাদের। অত্যন্ত জটিল হওয়ায় এই কাজ সম্পর্কে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের ধারণা থাকেনা। রবিবার (১৩ অক্টোবর) এক মানববন্ধনে ক্ষোভের সাথে এমন কথাই বলেন দেশের সমুদ্রবিজ্ঞানীগণ। এ সময় সামরিক কর্মকর্তার নাম প্রত্যাহার করে একজন বিজ্ঞানিকে মহা-পরিচালক(ডিজি) নিয়োগ দিতে সরকারের প্রতি আহবান জানান তাঁরা।
সাম্প্রতিক সময়ে ( ৭ অক্সটোবর ২০২৪) সরকার বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক পদে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে পদায়িত করে। এ কারণেই সরকারের প্রতি তাঁদের এই ক্ষোভ। সরকারের এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহার করে একজন সমুদ্র বিজ্ঞানিকে এই দায়িত্ব দেয়ার দাবিতেই মানববন্ধনও করেন বিজ্ঞানিগণ। পাশাপাশি কক্সবাজার শহরতলীর পেঁচারদ্বীপস্থ ইনস্টিটিউটের প্রধান ফটকের সামনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন, ইনস্টিটিউটের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো: হাসিবুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো: শরীফ, মো: জাকারিয়া, মাহবুব ই কবির, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সুলতান আল নাহিয়ান প্রমুখ।
এ সময় বক্তারা বলেন, সমুদ্র গবেষণা বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা নেই এই ধরনের একজন ব্যক্তির মাধ্যমে গবেষণা পরিচালিত হলে ইনস্টিটিউট দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। যার খেসারত গুণতে হবে দেশ, জাতি ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে।
প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানীরা জানান, গত ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে পদায়নের প্রস্তাব করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। যা এই ধরনের গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ এবং গবেষণার গ্রহণযোগ্যতার পরিপন্থি। এই প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী এই পদায়নের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ইতোমধ্যে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে ।
বিজ্ঞানীরা আরও জানান, মহাকাশ গবেষণার পর সমুদ্র গবেষণাকেই জটিল ও নিবিড় গবেষণা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন এই প্রতিষ্ঠানটির মুক্তভাবে গবেষণার অধিকতর সুযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, চীন, রাশিয়া এমনকি ভারতে দেখা যায়, এই ধরনের গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ একাডেমিশিয়ান বা বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত হয়, সামরিক বাহিনীর দ্বারা নয়। সামরিক বাহিনীর আওতায় পরিচালিত গবেষণা চাপিয়ে দেওয়া গবেষণা হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এসব গবেষণার ফলাফল আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয় না।
কর্মকর্তারা জানান, নবসৃষ্টি বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফলাফলসমূহ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে এবং অল্প সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে দেশের উপকূলীয় সমুদ্র এলাকার মূল্যবান খনিজ চিহ্নিত করেছে। সীউইড থেকে অনেক ধরনের বাণিজ্যিক উপাদান আহরণ করেছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক গবেষণা ও অয়েল স্পিল গবেষণার মাধ্যমে সমুদ্রের পরিবেশ নিয়ে কাজ করে প্রশংসিত হয়েছে; সামুদ্রিক প্রাণী থেকে ঔষধ, প্রসাধনী, পলিথিন ও নিত্য প্রয়োজনীয় উপাদান উৎপাদন করা হয়েছে এবং উপকূলীয় ভাঙন রক্ষা ও সমুদ্রের ইকোসিস্টেম উন্নয়ন বিষয়ে গবেষণা করছে। বঙ্গোপসাগর বিশ্বের কার্বন সাইকেলের ১০-২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং কার্বন নিঃসরণের ক্ষতি কমিয়ে কার্বন সিংক করতে বিশাল ভূমিকা রাখে। এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করা হচ্ছে। যা ভবিষ্যতে কার্বন ট্রেড নেগোশিয়েশনে বিপুলভাবে সহায়তা করবে।
এছাড়াও স্যাটেলাইটভিত্তিক ফিশিং জোন চিহ্নিতকরণ ও অফসোর অঞ্চলে বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্যতা নির্ণয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও গবেষকরা ওশানোগ্রাফি বিষয়ে এই প্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করছে। বর্তমানে জাপানের শিক্ষার্থীরা আমাদের ল্যাবের সহায়তা নিয়ে যৌথভাবে গবেষণা কাজ করছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের দাবি খুবই স্পষ্ট। সমুদ্র বিষয়ক স্বনামধন্য যেকোনো বিজ্ঞানী, একাডেমিশিয়ান বা সিভিল ব্যক্তিত্বকে এই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক হিসাবে পদায়ন করা হোক। এটি কোনো ব্যক্তিক স্বার্থের দাবি নয় বরং একটি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তা বজায় রেখে মুক্ত গবেষণার সহায়ক হিসাবে এই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব রক্ষার দাবি। এই দাবিটি সরকারের গুণগত সংস্কার কার্যক্রমের সহায়ক। আমাদের আরো দাবি থাকবে, সরকার যেকোনো পরিবর্তনই করুক না কেন, এই পরিবর্তন যেন প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরণ ও বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং এতে যেন প্রতিষ্ঠানের গুণগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।