ঢাকা বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০২৪
উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা ঘাটতির চোখ রাঙানি বাজেট
  • নিজস্ব প্রতিবেদক:
  • ২০২০-০৬-১১ ২০:৪৩:৫১

 করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) পুরো বিশ্ব জর্জরিত। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে জীবন রক্ষার্থে অর্থনীতির ক্ষতি মেনে নিয়েই বিভিন্ন দেশ লকডাউন ঘোষণা করে। বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের কারণে ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ছিল। পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক না হওয়ায় সীমিত পরিসরে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে সরকার। এ অবস্থায় ঘোষণা করা হলো ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট।

যদিও বাজেটে করোনায় ক্ষতি বা বিপর্যয় নিয়ে তেমন কিছুই বলা হয়নি। এমনকি করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বাজেটে নেই নতুন কোনো ঘোষণা। এছাড়া করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নে কী করা হবে, তার কোনো নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি বাজেটে।

‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা’ শীর্ষক ১৩০ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতানুগতিকভাবে বিগত দিনের সাফল্যের কথাই বেশি বলে গেছেন। আর খুব দ্রুত করোনার ভয়বহতা কেটে গিয়ে অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।

বাজেট বক্তব্যের শেষ দিকে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি তার সৃষ্টির অকল্যাণে কিছুই করেন না, যা করেন কল্যাণের জন্যই করেন। তাই অবশ্য অচিরেই তিনি তার কল্যাণের সুশীতল ছায়ায় আমাদের আশ্রয় দিয়ে এই মহামারি ভাইরাস থেকে সবাইকে পরিত্রাণ দান করবেন এবং আমরা ফিরে যাব আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়, উম্মোচিত হবে এক আলোকিত ভোরের।’

করোনা দ্রুত কেটে গিয়ে অর্থনীতি স্বাভাবিক ধারায় ফেরার পাশাপাশি বাজেটে রয়েছে উচ্চাকাক্সক্ষার প্রতিফলন। এজন্য আগামী অর্থবছরের জন্য আট দশমিক দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে। যদিও বিশ্বব্যাংক গত সপ্তাহেই পূর্বাভাস দিয়েছে, আগামী অর্থবছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে এক শতাংশ। আর করোনার মধ্যে কীভাবে আট দশমিক দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে, তাও অর্থমন্ত্রী পরিষ্কার করেননি।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, কেবল রাজস্ব আহরণই নয়, বরং করোনাভাইরাসজনিত চলমান সংকটের কারণে পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতিকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনা এবং মানুষকে নতুনভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করা সময়ের দাবি। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দারও পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরে অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

এদিকে চলতি অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল আট দশমিক দুই শতাংশ। তবে করোনার কারণে তা সংশোধন করে পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও এটি অর্জন করা সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থমন্ত্রী নিজেও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সন্দিহান। বাজেট বক্তব্যে তিনি বলেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বছরের প্রথম আট মাসের হিসাবে আমাদের প্রবৃদ্ধির হিসাব কষেছিল সাত দশমিক আট ভাগ। কিন্তু দুঃখের বিষয় করোনার প্রভাব সারা বিশ্বের অর্থনীতির হিসাব-নিকাশকে সম্পূর্ণ ওলটপালট করে দিয়েছে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি ছিল শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা। কিন্তু কভিড-১৯-এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী দীর্ঘসময় ধরে চলা লকডাউনের কারণে রপ্তানি হ্রাস পাওয়ায় এবং প্রবাসী আয়ে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জিত না হওয়ায় চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সংশোধন করে পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসকে সঠিকভাবে মোকাবিলা ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব দৃঢ়তার সঙ্গে কাটিয়ে ওঠার স্বার্থে আমরা গতানুগতিক বাজেট থেকে এবার কিছুটা সরে এসেছি। সে কারণে এবারের বাজেটে সরকারের অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতকে এবার সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, যদিও এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক দুই শতাংশ। চলতি অর্থবছর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল বাজেটে চার দশমিক ৯ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে পাঁচ দশমিক এক শতাংশ।

অর্থমন্ত্রীর মতে, কৃষি হচ্ছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত। তৃতীয় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত হচ্ছে দীর্ঘ সাধারণ ছুটি ও লকডাউনজনিত কারণে দরিদ্র কর্মজীবী মানুষের কষ্ট লাঘবে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা সম্প্রসারণ। আর চতুর্থ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত ব্যাপক কর্মসৃজন ও পল্লি উন্নয়ন, যদিও বাজেট বরাদ্দে এর উল্টো চিত্র দেখা যায়।

কারণ আগামী অর্থবছরের জন্য কৃষিতে আনুপাতিকহারে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জন্য কৃষি খাতে বরাদ্দ ছিল পাঁচ দশমিক চার শতাংশ। আগামী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ অপরিবর্তিত (পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশ) রয়েছে। আর স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়নে বরাদ্দ সাত দশমিক দুই শতাংশ থেকে কমিয়ে সাত শতাংশ করা হয়েছে।

যদিও জনপ্রশাসন খাতে অর্থাৎ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৯ দশমিক ৯০ শতাংশ করা হয়েছে। আর শিক্ষা-প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ কমিয়ে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দকৃত ১৫ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ বাদ দিয়ে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক কমে যাবে।

এদিকে কর্মসৃজনের কথা বাজেটে বলা হলেও এর জন্য কোনো ধরনের বরাদ্দ বা কর্মপন্থা বক্তব্যে তুলে ধরেননি অর্থমন্ত্রী। আবার করোনার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির কথা বলা হলেও তাদের সহায়তায় নতুন কোনো প্যাকেজের ঘোষণা আসেনি বাজেটে। একইভাবে প্রবাস থেকে ফেরত এসে কর্মহীন হয়ে পড়াদের জন্য নেই কোনো বিশেষ সহায়তার ঘোষণা।

করোনায় দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী স্বীকার করলেও তার প্রভাব কতটা, তার কোনো পর্যবেক্ষণ নেই। বরং সরকারের ঘোষিত বিভিন্ন প্যাকেজের বর্ণনায় ব্যস্ত ছিলেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তব্যে তিনি বলেন, আগামী অর্থবছর অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম বছর, সুতরাং এ বাজেটে এর বাস্তবায়ন গুরুত্ব পাবে। অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জীবন ও জীবিকা রক্ষার ওপর প্রাধান্য দেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে সুর্নির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই বাজেটে।

এদিকে বাজেট কাঠামোয় এবার বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। ঋণনির্ভর এ বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য ব্যাংকঋণের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা, যদিও পরে তা সংশোধন করে করা হয়েছে ৮২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা।

কালোটাকা তথা অপ্রদর্শিত অর্থ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সম্পদ করের ক্ষেত্রে করমুক্ত সীমাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ধনীদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হলেও দরিদ্রদের জন্য কোনো সুযোগ রাখা হয়নি বাজেটে।

এদিকে আগামী অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার টাকা। চলতি অর্থবছর এ লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও পরে তা কমিয়ে তিন লাখ ৪৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ করোনাকালে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে অর্থমন্ত্রী নিজেই কিছুটা শঙ্কায় রয়েছেন।

বাজেট বক্তব্যে তিনি বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ছিল আট দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া এখনও চলমান রয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতির প্রভাবে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি কিছুটা হ্রাস পাবে। করোনার (কভিড-১৯) প্রকোপ সহজে দূর হবে না এবং আগামী অর্থবছরেও দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক হবে না বলে অনেকেই অভিমত পোষণ করেন। অনেকে আশঙ্কা করছেন, করোনার প্রাদুর্ভাবে অর্থনীতি গতি হারাবে এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধি কাক্সিক্ষত মাত্রায় হবে না। এ আশঙ্কার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই আমরা এবার রাজস্ব নীতি সাজিয়েছি।

বঙ্গবন্ধু জন্মেছিল বলেই জন্মেছে এ দেশ -হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি
অপ্রতিরোধ্য বাজার সিন্ডিকেট: মজুতের শাস্তি আটকে আছে বিধিতে
ডাইফ সেবা সপ্তাহ শুরু আজ
সর্বশেষ সংবাদ