ঢাকা শুক্রবার, ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪
কুড়িগ্রাম-১ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোন্দলে জর্জরিত
  • এম এস সাগর, কুড়িগ্রাম:
  • ২০২৩-১০-০৮ ০৬:০৬:২৫

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৫ কুড়িগ্রাম-১ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। মাঠে-ঘাটে ভোটের উত্তাপ শুরু হয়েছে। চলছে আলোচনা- সমালোচনা। প্রার্থীর দোষ, গুণ, কোন দল থেকে কে পাচ্ছেন দলীয় মনোনয়ন, কাকে মনোনয়ন দিলে জিতবে আবার কাকে মনোনয়ন দিলে হারবে এখন সর্বত্র এমন আলোচনা।

মনোনয়ন প্রত্যাশীরা পরিচিতি বাড়াতে নিজের ছবি সংবলিত বিলবোর্ড, ফেস্টুন ও ডিজিটাল ব্যানার লাগিয়ে সরগরম করে তুলছে ভোটের মাঠ। একই সঙ্গে মনোনয়নের জন্য দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও তদবিরও করছেন তারা। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলগুলোতে যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গ্রুপিং-লবিং।

ফিরে দেখা: এক সময় কুড়িগ্রাম জেলা জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই চিত্র এখন পাল্টে গেছে। টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন এবং কুড়িগ্রাম-১ আসনে দলের সংসদ সদস্য থাকায় মাঠে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থান আগের চেয়ে অনেক শক্ত। একাধিক আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী থাকায় এবং ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার সঙ্গে সরকার বিরোধী মনোভাবের কারণে পিছিয়ে নেই বিএনপিও। আর জাতীয় পার্টি তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে এবার মরণ কামড় দেবে-এমন আলোচনা রাজনৈতিক মহলে। কুড়িগ্রামে চরমোনাইর পীরের অনেক অনুসারী থাকায় সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ভোটের মাঠে তারাও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছেন। বিপুল ভোট-ব্যাংকের কারণে কোনো কোনো আসনে তাদের প্রার্থীরাও জয়ের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী। ২৫ কুড়িগ্রাম-১ আসন সমুহ নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নিয়ে। ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন বিরতি ছাড়া তৃতীয় থেকে দশম সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এই আসনে একচ্ছত্র আধিপত্য রেখেছিল জাতীয় পার্টি। তবে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছন্দপতন ঘটে। আওয়ামী লীগের দখলে যাওয়া এই আসনটিতে আগামী নির্বাচনেও নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। তবে, দলীয় কোন্দল আর একাধিক প্রার্থী নিয়ে অনেকটাই অগোছালো আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন সরকারে থাকার কারণে স্থানীয় কিছু নেতার ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে অনেকেই বেশ নাখোশ। যার প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা দলটির স্থানীয় ত্যাগী নেতাদের।

সংসদ নির্বাচন: ২৫ কুড়িগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের আসলাম হোসেন সওদাগরের নানা কার্যক্রমে বহুবার আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। যার প্রভাব সর্বত্রই পড়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগ সরকারের হাত দিয়ে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বলে মনে করেন সাধারণ ভোটাররা। সোনাহাট স্থলবন্দর চালু, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণ, সোনাহাট স্থলবন্দর হতে কুড়িগ্রাম হয়ে রংপুরগামী মহাসড়কের প্রশস্তকরণ এবং সড়কে বিদ্যমান ব্রিজ কালভার্ট প্রশস্তকরণ, নতুন কালভার্ট ও ব্রিজ তৈরিকরণ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজের বিপরীতে সোনাহাট স্থলবন্দরগামী ধরলা-১, ধরলা-২ ব্রিজ নির্মাণ, ভূরুঙ্গামারীতে ব্রিটিশ ভারতের ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজের পাশে আর একটি ব্রিজ নির্মাণরত, ধরলা, দুধকুমার ও ফুলকুমার নদীর নাব্য ফিরাতে জরিপ ও খনন কার্যসহ দুই তীরে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে। এত উন্নয়ন কার্যক্রমে কারণে আওয়ামী লীগ আসনটিতে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। তবে স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন কুড়িগ্রাম-১ আসনটিতে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয় তবে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিএনপির প্রার্থী একাধিক না হলেও তাদের দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে চরম বিপর্যয়ে পড়েছে দলটি। অবস্থা এমন কেউ কাউকে মানতে চাইছে না। যদিও নির্বাচনে জামায়াতের ভোট বিএনপি প্রার্থীই পাবে এ আসনে। কারণ ভূরুঙ্গামারী এলাকায় জামায়াতের অবস্থান বেশ শক্ত। যদিও তারা প্রকাশ্যে রাজনীতি না করলেও গ্রামে-গঞ্জে তাদের নেতাকর্মীরা গোপনে কাজ অব্যাহত রেখেছে।

প্রবীণ নেতা মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম শামসুল হক চৌধুরী একজন মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক (তৎকালীন গভর্নর) জন্মস্থান হওয়ায় ভূরুঙ্গামারী এলাকায় আওয়ামী লীগের একটি বড় ভোট-ব্যাংক রয়েছে। প্রতিবার নির্বাচনে এই ভোট-ব্যাংককে আওয়ামী লীগ কাজে লাগায়। বিগত নির্বাচনের তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৯১ সালে এই আসনে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির এ কে এম সহিদুল ইসলাম বাচ্চু।

১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাকের হাত ধরে আসন ফিরে পায় জাতীয় পার্টি। এরপর ২০০১, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম, নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির পতাকা ধরে রাখেন মোস্তাক। একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো আসনটি নিজেদের দখলে নেয় আওয়ামী লীগ। নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন আসলাম হোসেন সওদাগর।

আগামী সংসদ নির্বাচনে এ আসনটি জাতীয় পার্টির দখলে নেওয়ার লক্ষ্যে সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাকের ওপরই ভরসা করছে দলটি। তৃণমূলে জনপ্রিয় সাবেক এই সংসদ সদস্য দলীয় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বলে দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে। নিজের প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক বলেন, জাতীয় পার্টি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে মনোনয়ন চাইব। সে অনুযায়ী কাজ করছি।

তবে জাপার একক প্রার্থী থাকলেও বড় দুই দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে তরুণ প্রার্থীসহ একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন। যদিও দল দুটির মধ্যে একাধিক গ্রুপ সৃষ্টি হয়ে অন্তর্কোন্দল দেখা দিয়েছে। 

আওয়ামী লীগ থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য ছাড়াও মনোনয়ন প্রত্যাশী আছেন- শিল্পপতি ও দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, নাগেশ্বরী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মোস্তফা জামান, জেলা আওয়ামীলীগের শিল্প ও বানিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম মাজু, কেন্দ্রীয় যবলীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপ-সম্পাদক ডা. মাহাফুজুর রহমান উজ্জল ও বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি ইসহাক আলী জিকো।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেন, ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী পরিবারে জন্ম। দাদা বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম শামসুল হক চৌধুরী একজন মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক হিসেবে মানুষের সেবা করেছেন। দায়বদ্ধতা থেকে আমিও মানুষের সেবা করবো। যতটুকু সম্বল আছে, ততটুকু দিয়েই মানুষের পাশে দাঁড়াব। নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সকল মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের পরীক্ষিত সৈনিক ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে নৌকা মার্কার পক্ষে তিনি জনমত গঠনে কাজ করে যাচ্ছেন। আমাকে কুড়িগ্রাম ১ আসনে মনোনয়ন দিলে আমি দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ আসনটি উপহার দেব। তৃনমূল পর্যায়ের অনেক আওয়ামীলীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগনের কাছে শোভন এখন চোখের মনি। কুড়িগ্রাম ১ আসনের সাধারন জনগন শোভনকে নৌকার মাঝি হিসেবে দেখতে চায়।

নাগেশ্বরী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মোস্তফা জামান বলেন, আমি নিয়মিত জনসংযোগ করছি। মানুষের দ্বারে গিয়ে সরকারের উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছি। তৃণমূল নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি। আমার প্রত্যাশা, দল তৃণমূলের কথা শুনলে আমি মনোনয়ন পাব এবং নৌকার জয় নিশ্চিত করতে পারব।

কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের শিল্প ও বানিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম মাজু বলেন, কুড়িগ্রাম-১ আসনের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। নির্বাচনকে সামনে রেখে নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার সর্বত্র নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সরকারের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরছি।

ডা. মাহাফুজুর রহমান উজ্জল বলেন, জনগণ যদি একবার আমাকে সুযোগ দেয় তাহলে আমি মানুষের উন্নয়নের সব কাজ করব। মানুষের জন্য কাজ করছি দীর্ঘদিন থেকে।

বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি ইসহাক আলী জিকো বলেন, আমি আওয়ামীলীগ পরিবারের সন্তান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আদর্শে দেশকে এগিয়ে নিতে ইচ্ছুক। আমি আওয়ামীলীগ কে ত্বরানিত্ব করার লক্ষে নিজের অর্থায়নে মিছিল, মিটিং, সভা, সেমিনার প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ মিছিল করাসহ অসহায় পরিবারের মাঝে সেবা দিচ্ছিসহ মানবতার সেবায় ব্যস্ত সময় পার করছি। মানচিত্র বিকৃত হয়, কিন্তু ইতিহাস বিকৃত হয় না।

বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন বিটিএফ, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (রংপুর বিভাগ) এর কাজী মো: লতিফুল কবীর রাসেল বলেন, কুড়িগ্রাম-১ আসনের তৃণমূল পর্যায়ের বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের নেতাকর্মীর সঙ্গে সব সময় গভীরভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার সর্বত্র নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সরকারের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরছি।

কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা ’৯৬ নির্বাচনে জয়ী হয়েও সংসদ সদস্য হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ না করায় আবারও এই আসনে লড়বেন বলে জানা গেছে। সাইফুর রহমান রানার দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তার দল ও তিনি প্রার্থী তা নিয়ে ভাবছেন না।

দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই আসনে বিএনপির একাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল চরমে। নাগেশ্বরী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি গোলাম রসুল রাজা দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। সে লক্ষ্যে এই তরুণ নেতারা জনসংযোগেও অংশ নিচ্ছেন।

সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে বিএনপির প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন বিএনপির প্রার্থী সাইফুর রহমান রানা। আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন বিটিএফ, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (রংপুর বিভাগ) এর কাজী মো: লতিফুল কবীর রাসেল, জামায়াতে ইসলামীর মাওলানা আজিজুর রহমান স্বপন এবং ইসলামী আন্দলনের গোলাম মোস্তফা আনছার আলী রয়েল এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন।

শ্রমিকদের ধর্মঘটে অচল আশুগঞ্জ নদী বন্দর
ডাকাতির প্রস্তুতিকালে গণপিটুনিতে  একজনের মৃত্যু
ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতকে সকল সুবিধা দিত হাসিনা:  আলতাফ হোসেন চৌধুরী