রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে আওয়ামী লীগ নেতা মুনজুর রহমান পিটারের বিরুদ্ধে ১০ জন কৃষকের সাত বিঘা জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক পিটার উপজেলার সাব্দিপুরে ‘এএইচ ইকো ব্রিকস’ নামের একটি অনুমোদনহীন ইটভাটা পরিচালনা করছেন। গোদাগাড়ী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এক আদেশে কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দিলেও সেটি মানছেন না পিটার।
অভিযোগ উঠেছে, ইটভাটা পরিচালনার জন্য পিটার গোদাগাড়ী উপজেলা প্রশাসনের অনুমোদন নেননি। চলতি বছরের ৯ জুলাই সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যে গোদাগাড়ী উপজেলায় ২৪টি ইটভাটার তালিকা রয়েছে। এ তালিকায় পিটারের মালিকনাধীন এএইচ ইকো ব্রিকস নামের ইটভাটাটি নেই। ইটভাটাটি পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদনও নবায়ন করেনি। এছাড়া পিটারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টিও প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
এদিকে দখলকৃত জমি আওয়ামী লীগ নেতা পিটারের কাছে ফেরত চাওয়ায় উপজেলার ভাটোপাড়া এলকার কৃষক আয়নুল হকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। তাকে চিমনির (ইট পোড়ানোর যন্ত্র) মধ্যে ফেলে হত্যার হুমকি দিয়েছেন পিটারের লোকজন। তাকে জেল খাটানোরও ভয় দেখানো হয়েছে। এছাড়া অন্য জমির মালিকদেরও ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে সাব্দিপুর এলাকায় রাজশাহী মহানগরীর গোলাম আরিফ জিয়া নামের এক ব্যবসায়ী সাত বিঘা জমিতে ‘জিয়া ইকো ব্রিকস’ নামের একটি ইটভাটা প্রতিষ্ঠা করেন। বিঘায় বাৎসরিক ১১ হাজার টাকা চুক্তিতে ওই এলাকার আয়নুল হক, তার মা তহমিনা খাতুন, ভাতিজা আনাম, সাবেক সেনা সদস্য আফজাল হোসেন, বোরহানুল ইসলামসহ ১০ জন কৃষকের কাছ থেকে জমি ইজারা নেন জিয়া। এরপর ইটভাটাটি উৎপাদনে যায়।
তবে কারিগরি ও অবকাঠামোগত জটিলতায় ২০১৯ সালে ইটভাটাটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর জমির মালিকরা জমি ফেরত পেতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর আবেদন করেন। এরপর ওই বছরের ২১আগস্ট স্মারক নং ০৫.৪৩.৮১৩৪.০০১.০০১১.১৯-১৩৯১(৩)এক আদেশে তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুহাম্মদ ইমরানুল হক ইটভাটাটি পরিত্যক্ত হওয়ায় মালিকদের জমি ফেরত দেওয়ার আদেশ দেন। তবে জমি ফেরত দেননি জিয়া। এ অবস্থায় গত বছরের শুরুতে ‘জিয়া ইকো ব্রিকস’-এর সাইনবোর্ড পালটে সেখানে ‘এএইচ ইকো ব্রিকস’ নিজস্ব মালিকনায় চালু করেন আওয়ামী লীগ নেতা পিটার।
জমির মালিক আনাম বলেন, আমরা জিয়াকে জমি ইজারা দিয়েছি। জিয়ার সাথে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু জিয়া জমির দখল না ছেড়ে সেটি আওয়ামী লীগ নেতা পিটারের কাছে হস্তান্তর করেছেন। পিটার এখন নতুন দখলকারী। মালিকরা জমি ফেরত চাইলে পিটার ও তার লোকজন ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন।
মালিক আয়নুল হক জমি ফেরত চাওয়ায় তার বিরুদ্ধে গত মাসে গোদাগাড়ী সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা হয়েছে। আয়নাল বলেন, আমি হার্টের রোগী। জমি ফেরত চাওয়ার কারণে আমাকে মামলা দিয়ে জেল খাটানোর হুমকি দিচ্ছেন পিটার ও তার লোকজন। জমিতে গেলে চিমনির আগুনে ফেলে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে। চার বছর ধরে জমির ইজারার টাকা পাইনি। ফসল ফলাতে পারিনি। সব মিলিয়ে আমরা জমির মালিকরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি।
অপরদিকে আওয়ামী লীগ নেতা পিটারের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ভাটাটিতে প্রতিদিন ২০ হাজার ইট উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি হাজার ইট ১৩ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। এ হিসাবে প্রতি মাসে ৭৮ লাখ টাকার ইট বিক্রি হয়। এক বছরে এর পরিমাণ ৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। কিন্তু ইট বিক্রির রসিদে টাকার পরিমাণ উল্লেখ থাকছে না। ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
রাজস্ব ফাঁকিসহ বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আতিকুল ইসলাম বলেন, আমি কয়েকদিন হলো গোদাগাড়ীতে যোগদান করেছি। বিষয়টি আমার জানা নেই।তবে এখন একটি অভিযোগ পেয়েছি।এবং আমি অলরেডি এসিল্যান্ডকে বলে দিয়েছি সেখানে সরজমিনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে সঠিক তদন্ত করে অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।
গোদাগাড়ী উপজেলা দায়িত্বপ্রাপ্ত ভূমি কর্মকর্তা(এ্যাসিল্যান্ড)মোঃ জাহিদ হাসান প্রতিবেদককে বলেন তদন্ত করে অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।কিন্তু সরজমিনে গিয়ে দেখাগেছে, ভুক্তভোগী খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষকদের তিনি দিনের পর দিন ঘোরাচ্ছে।এবং অভিযোগকারীদের অভিযোগের ফাইল ভূমি কর্মকর্তার অফিস থেকে উধাও হয়ে গেছে বলেও চারিদিকে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
অভিযোগের বিষয়ে জমির ইজারা গ্রহণকারী গোলাম আরিফ জিয়া বলেন, বর্তমানে নাম গোপন করে ইটভাটাটি চলছে। কারণ, জিয়া নামে চললে কিছু সমস্যা আছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগ নেতা মুনজুর রহমান পিটার বলেন, ভাটাটি আমি এখনো কিনিনি। তবে কিনে নেব। কাগজপত্র জিয়ার কাছে আছে। তবে ইটভাটাটি এখন আমার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। আর জমির ইজারার টাকা মালিকদের জিয়া দেবে।
তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি ঢাকায় থাকি। আর জমির মালিককে চিমনিতে ফেলে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগটিও বানোয়াট। এছাড়া উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশসহ বিভিন্ন দপ্তরের অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগটিও মিথ্যা। কারণ, সব বিক্রেতার কাছে ইটের দাম এক নেওয়া হয় না। ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি করা হয়। এ কারণে রসিদে টাকার বিষয়টি উল্লেখ থাকে না বলে দাবি করেন তিনি।