আঞ্চলিক রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। চীন-ভারতের চলমান বৈরিতায় তৈরি হওয়া কিছু ঘটনা বাংলাদেশকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।
তবে, আলোচনার এই কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা বাংলাদেশের জন্য খুব একটা স্বস্তিদায়ক নয়। বরং রয়েছে সম্পর্ক রক্ষার চাপ ও জটিলসব হিসেব নিকেশ। ঐতিহাসিক সম্পর্কের জোরে বহুদিনের পুরনো মিত্র ভারত যেমন বাংলাদেশকে এই সময়ে পাশে চায়, তেমনি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কাছের বন্ধু হয়ে ওঠা চীনও আমাদের জবাবের অপেক্ষায়।
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা পর পর সাজালে দেখা যাবে, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে দেশ দুটির কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। মাস খানেক আগে বাংলাদেশকে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিশাল এক ছাড় দেয় চীন। সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, দেশটির তৈরি করা করোনাভাইরাসের টিকা আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাব।
বর্তমান কঠিন সময়ে এই ধরনের সহযোগিতা অবশ্যই বাংলাদেশ-চীনের মধ্যকার বন্ধুত্বের ক্রমবর্ধমান রেখাকেই ইঙ্গিত করে। কিন্তু নতুন এই সম্পর্ক বাংলাদেশের পুরনো বন্ধু ভারতের জন্য অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে, যা দেশটির গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক বেশ কিছু প্রতিবেদন দেখলে আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। যদিও চীনের এসব উদ্যোগের পরও বাংলাদেশ দেশটির দিকে ঝুঁকে পড়েনি; তারপরও স্বস্তিতে নেই ভারত।
চীনের মতো বৃহৎ কোনো বাণিজ্যিক সুবিধা বাংলাদেশের জন্য ঘোষণা না করলেও, ভারত মাঠ ছেড়ে দিতে রাজি নয়। চীনের ঘোষণা দুটি আসার পরপরই নিজের অবস্থান জানান দিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শংকর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে একটি চিঠি পাঠান। তাতে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মিয়ানমারে দ্রুত প্রত্যাবাসনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।
আমার জানামতে, রোহিঙ্গা বিষয়ে ভারত প্রথম থেকে যথেষ্ট কৌশলী অবস্থানে। নানা সময়ে মধ্যপন্থী কথাবার্তা ছাড়া ভিন্ন কিছু শোনা যায়নি ভারতের কণ্ঠে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের চিঠি আমার মনে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায়, চিঠিতে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গটি তুলে আনার কারণ খুব সহজেই বুঝতে পারি আমরা।
শুধু তাই নয়, দিল্লি ঢাকার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন, জুলাই মাসে দেশটির গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য আসার পর দেশটির সরকার খুব দ্রুত এর জবাব দেয়। সম্পর্ক আগের মতো শক্তিশালী আছে দাবি করে বাংলাদেশকে সু-প্রতিবেশীর রোল মডেল বলে অভিহিত করে ভারত।
বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত-চীনের এই লড়াইয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে পাকিস্তান। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ফোন এবং পরবর্তীকালে এই ফোনালাপ নিয়ে ইসলামাবাদের বিবৃতি দেখে বোঝা যায়, সম্পর্ক উদ্ধারে দেশটি কতটা সচেষ্ট। আর তাই যদি সত্য হয়, তবে পাকিস্তানের এই তৎপরতা নিঃসন্দেহে ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় একা করার পাশাপাশি চীনের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।
তবে বর্তমানে তলানিতে থাকা বাংলাদেশ-পাকিস্তানের এই কূটনৈতিক সম্পর্কটা শেখ হাসিনার সরকারের সময় কতটা উন্নতি করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
অবশ্য ভারত-চীন-পাকিস্তান বাংলাদেশকে যতই কাছে পাওয়ার চেষ্টা করুক, ঢাকা এখনো কৌশলী অবস্থানে রয়েছে। চীন-ভারতের দ্বন্দ্বে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো যতটা শামিল হয়েছে, বাংলাদেশ এখনো নীরব। বাংলাদেশের এই অবস্থানকে বিশ্ব গণমাধ্যম কৌশলী ও কার্যকর বলছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন বাংলাদেশ চীন-ভারতের দ্বন্দ্বে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল? এর পিছনে কি শুধু দল ভারি করার উদ্দেশ্য, নাকি বাড়তি কোনো চিন্তাও আছে?
যদি সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় আনা হয়, তবে এ কথা পরিষ্কার, ভৌগলিক অবস্থানের কারণেও বাংলাদেশ এই দুই প্রতিবেশীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অনেকটুকু নিয়ন্ত্রণ থাকায় দুই দেশের আগ্রহটা তাই একটু বেশি। আর এ হিসেব কষেই গত কয়েক বছর ধরে চীন বাংলাদেশে করছে মেগা বিনিয়োগ। দেশটি এখানে পদ্মা সেতুসহ বেশ কয়েকটি সর্বাধুনিক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ও করছে। সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে সামরিক সহযোগিতাও।
আর এসব পদক্ষেপে বাংলাদেশের বহুদিনের মিত্র ভারত মোটামুটি নড়েচড়ে বসে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এই নতুন সম্পর্ককে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে ভারতও বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেয়। তবে তা চীনের তুলনায় বেশ কম।
এখন পর্যন্ত চীন বাংলাদেশে ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করছে, যা ভারতের বিনিয়োগের প্রায় ৫ গুণ।
২০১৯ সালে চীন থেকে বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ এসেছে এক হাজার ৪০৮ মিলিয়ন ডলার। আর একই সময়ে ভারত থেকে নতুন বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ১৫০ মিলিয়ন ডলার।
নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও চীনের ধারে-কাছেও নেই ভারত। সরাসরি বিনিয়োগের (এফডিআই) ক্ষেত্রেও ভারতের চেয়ে এগিয়ে চীন। তবে যার বিনিয়োগের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, এই অঞ্চলে চীন-ভারতের প্রভাব বহুমাত্রিক। এই অবস্থায় বৃহৎ দুই শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের সমান সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং; কিন্তু অসম্ভব নয়। বাংলাদেশ তার বন্ধুৃত্বের নীতি দিয়েও আগেও এই ধরনের সমস্যার সমাধান করেছে। তবে এবার প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। এবার সু-সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি, বাংলাদেশে দু'দেশের বিনিয়োগ নিশ্চিত করাটাও গুরুত্ব সহকারে স্থান পাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীন-ভারতের বৈরিভাব বাংলাদেশের জন্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ঘাটতি মেটাতে একটা বিরাট দ্বার উম্মোচন করেছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে এফডিআই এসেছে ১৫৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা গত ৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
কোভিড-১৯ পরবর্তী এফডিআই আকর্ষণে বাংলাদেশকে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। তাই চীন-ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ ও করোনা পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগের মন্দাভাব কাটাতে এই দুই দেশের বিনিয়োগকে কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ।
তবে চীনের বিনিয়োগ প্রশ্নে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চীন বাংলাদেশে তার অধিকাংশ বিনিয়োগ দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় করে আসছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। কিন্তু সমস্যা হলো, ভারত এই বিআরআই-এর ঘোর বিরোধী।
ভারতের বিরোধিতা ছাড়াও বিআরআইকে নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়েছে এই অঞ্চলে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাতে চীনের এই বিনিয়োগ নিয়ে ইতোমধ্যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ নিয়েও।
কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে পরিস্থিতি ভিন্ন। তাদের মতে, বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত সচেতন গ্রহীতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছে এবং এই পদ্ধতি অন্যদের জন্য শিক্ষণীয়।
বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতে চীনের মতো সহযোগিতা করছে ভারতও। এই সহায়তা ২০১৫ সালে ছিল তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার; বর্তমানে ৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
বিনিয়োগ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরও কিছু উদাহরণ রয়েছে। সম্প্রতি ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রথম ভারতীয় পণ্য পরিবহন ও বাংলাদেশের কাছে দশটি রেল ইঞ্জিন হস্তান্তর উলেখযোগ্য।
আরেকটু পিছনে ফিরে তাকালে, ৪১ বছর ধরে ঝুলে থাকা স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন ও সমুদ্র বিরোধ মেটানোও দু'দেশের সু-সম্পর্ক ইঙ্গিত করে। যদিও সমুদ্র বিরোধ মেটাতে নেদারল্যান্ডের স্থায়ী সালিশি আদালতে যেতে হয়েছিল; তারপরও আদালতের রায় মেনে নেয় দু'দেশ।
এসব উদাহরণ টেনে ভারতীয় নেতারাও দুই দেশের সম্পর্ককে 'সোনালী অধ্যায়' হিসেবে অভিহিত করেন প্রায় সময়ে। তবে 'সোনালী অধ্যায়' মাঝে মধ্যে হোঁচট খায়, যখন তিস্তা, সীমান্তে হত্যা ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দিল্লির আশানুরূপ জবাব পেতে ঢাকা ব্যর্থ হয়।
চীন-ভারতের বৈরিতা থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের প্রয়োজন বিনিয়োগবান্ধব অবকাঠামো তৈরি করা। অবশ্য চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগ টানতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ। নির্মাণাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে এই দুই দেশের বিনিয়োগকারীদের প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি এখানে উল্লেখযোগ্য।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বৈদেশিক মুদ্রার (এফসি) অ্যাকাউন্ট খোলার যে সুযোগ করে দিয়েছে, তা থেকে চীন-ভারতের বিনিয়োগকারীরা সুবিধা পাবে বলে মনে করে অর্থনীতিবিদরা। তবে সব ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কিছু বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। যেমন, নানা কারণে কিছু প্রকল্প ধীরগতিতে চলছে। প্রকল্পের অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে বিলম্বের ঘটনাও আছে। এসব বিষয়ে তদারকি বাড়াতে হবে সরকারকে।
পাশাপাশি, ঋণের বোঝা যাতে প্রকল্প সম্পাদনে বিলম্ব বা অন্য কোনো কারণে না বাড়ে, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থায় পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
তাই দুই দেশের চাপ সামলানোর পাশাপাশি দেশে চলমান বিনিয়োগগুলোর বিষয়ে সরকারের সঠিক নজরদারি বাড়াতে হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী