ঢাকা শনিবার, ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪
বুরো হাসপাতাল টাঙ্গাইল নবজাতকের স্পেশাল কেয়ার নিউবর্ন ইউনিট এনআইসিইউ
  • তুহিন খান, টাঙ্গাইল
  • ২০২৩-০৫-২৩ ০৫:৩০:০৯
নবজাতকের চিকিৎসা সেবায় এনআইসিইউ খুবই গুরুত্বপুর্ন ভ‚মিকা পালন করে থাকে। সারাদেশে এনআইসিইউ সল্পতা রয়েছে এই কথা চিন্তা করে বুরো হাসপাতাল টাঙ্গাইলে সর্ব প্রথম বেসরকারী পর্যায়ে ২০২১ সালের সেপ্টে¤বরে থেকেই প্রথম নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (এনআইসিইউ) চালু করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত এই ইউনিটের মাধ্যমে প্রায় ১১৫০ শিশুর নিবির পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছে যার ফলে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হয়েছে। এই ইউনিট চালুর পর থেকে এই বিভাগে সেবা প্রদানকৃত ১১৫০ জন শিশুর মধ্যে মৃত্যুহার ৩.৯% যেখানে সরকারি পর্যায়ে এই হার ১৬-৩০% পর্যন্ত উঠানামা করে থাকে। শিশুর মৃত্যুহার কমানোর বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জন করে বাংলাদেশ 'উন্নয়ন আইকন' হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তবে এখনো নবজাতকের মৃত্যুহার উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। দেশে প্রতি ঘণ্টায় ১০ থেকে ১১ জন নবজাতকের মৃত্যু হচ্ছে। সে হিসাবে বছরে মারা যাচ্ছে ৯০ হাজার নবজাতক। টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালের (শিশু বিভাগ) এর কনসালটেন্ট ডা. সাইফুল ইসলাম জানান, নবজাতক মৃত্যুর বড় অংশটিই হয় জন্মের প্রথম দিন। মোট মৃত্যুর ৫২ শতাংশই হচ্ছে জন্মের প্রথম দিন। জন্মের ২ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ৮ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে ১৮ শতাংশের মৃত্যু হচ্ছে। দেশে শতকরা ৩০ ভাগ অপূর্ণাঙ্গ বাচ্চার জন্ম হয়। এদের ১০ শতাংশ প্রি-ম্যাচিউর বা নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্ম নেওয়া শিশু। বাকি ২০ শতাংশ জন্মগতভাবে বিভিন্ন রোগব্যাধি বা শারীরিক ক্রুটি ও কম ওজন নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়। অসুস্থতা বিবেচনায় এসব নবজাতকের নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (এনআইসিইউ) চিকিৎসা সেবার প্রয়োজন হয়। অথচ দেশের হাসপাতালগুলোতে এ ধরনের সেবা ব্যবস্থা খুবই নগণ্য। দেশের ৩৬টি জেলা এবং চারটি আঞ্চলিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নবজাতকের জন্য স্পেশাল কেয়ার নিউবর্ন ইউনিট বা স্ক্যানু বিশেষায়িত সেবাব্যবস্থা থাকলেও বেসরকারিভাবে এই সেবা নামমাত্র। ২০২২ সালের মধ্যে ৬৪টি জেলা হাসপাতালে স্ক্যানো চালুর কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ৫০ জেলায় এ সেবা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, অপরিপুষ্ট বাচ্চাগুলো সাধারণত হাইপোথারমিয়াতে ভোগে। তারা তাদের তাপমাত্রা রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে না। তাদের ব্রেইন, হার্ট, চোখ ও ফুসফুসসহ প্রত্যেকটি অঙ্গ অপরিপুষ্ট থাকে। জন্মের পর তাদের শ্বাস কষ্ট দেখা দেয়। এসব শিশুর জন্য দরকার নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (এনআইসিইউ)। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা শিশু হাসপাতাল, এনআইসিইউ মিলে বেড সংখ্যা একশো এর ও কম। প্রয়োজনের তুলনায় চাহিদা ১০ গুণ বেশি হওয়ায় ছুটতে হয় বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। কিন্তু যাদের সে সামর্থ্য নেই তাদের পড়তে হয় মহাবিপাকে। বুরো হেলথ কেয়ার ফাউন্ডেশন এর পরিচালক রাহেলা জাকির বলেন , মায়ের পেটে লালিত হওয়ার পর আলো বাতাসের ধরাধামে শিশু যখন ভূমিষ্ট হয় তখন চিৎকার দিয়ে তার আগমনী বার্তা জানান দেয়। এই চিৎকার বা কান্না যে কোন দম্পত্তি বা তার স্বজনদের বহু আকাঙ্খিত। জন্মের পর নবজাতক মায়ের কোলে লালিত হবে। তার একটি নাম হবে। সবার আদরে বড় হবে। এটিই সবার কাম্য। কিন্তু মায়ের নাড়ী ছেড়ে পৃথিবীতে এসে যখন নিজের নাম ধারন করার পূর্বেই নবজাতককে পড়তে হয় জীবন সংকটে; তখন দিশেহারা হয়ে যান অভিভাবকরা। সন্তানের জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেন হাসপাতালে। দেশের অধিকাংশ বেসরকারী হাসপাতাল বর্তমানে দালাল এরং কমিশন নির্ভর । দালাল এরং কমিশন নির্ভর এসব হাসপাতাল গুলোতে রোগীরা বিভিন্ন ভাবে প্রতারিত হচ্ছেন । এই প্রতারণা থেকে মুক্তির জন্য বুরো বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করার জন্য বুরো হেলথ কেয়ার ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন এই ফাউন্ডেশনের আওতায় ৪০ শয্যাবিশিষ্ট একটি পুর্নাঙ্গ বুরো হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। এই হাসপাতালের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সম্পুর্ন দালাল এবং কমিশন মুক্ত, স্বল্প মূল্যে এবং মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা। প্রতিষ্ঠার মাত্র ২ বছরের মাথায় শিশু মৃত্যুহার কমানোর লক্ষ্যে আমরা নবজাতকের নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (এনআইসিইউ), টাঙ্গাইলে বেসরকারীভাবে প্রথম এনআইসিইউ প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে এনআইসিইউ কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, টাঙ্গাইলে ৪০ লক্ষ মানুষের বাস এখানে দীর্ঘদিন মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে যে বিষয়টা পরিলক্ষিত হয়েছে সেটা হলো স্বাস্থ্যসেবা পেতে মানুষকে অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। সে লক্ষ্যে এ বিড়ম্বনা থেকে রেহাই দিতে বুরো হেলথ কেয়ার ফাউন্ডেশন একটি সুন্দর মনোরম পরিবেশে মানুষকে মান সম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে বুরো হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে । তিনি বলেন বিশেষ করে বাংলাদেশে গর্ভবতী মায়েরা অধিকাংশ সময়েই চিকিৎসার জটিলতায় ভোগেন তাদেরকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হলে একটি সুস্থ্য শিশু জন্ম দিতে পারে। সে লক্ষ্যে বুরো হেলথ কেয়ার ফাউন্ডেশন গ্রাম পর্যায়ে গর্ভবতী মায়েদের তালিকা প্রণয়ন করে নিয়মিত পরামর্শ প্রদান করে আসছে। বুরো হেলথ কেয়ার ফাউন্ডেশন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ভবিষ্যতে একটি মেডিকেল কলেজ এবং ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট একটি আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যে বুরো হেলথ কেয়ার ফাউন্ডেশন একটি ৪০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং একটি নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ এর সহকারী অধ্যাপক (নিউনেটোলজী) নবজাতক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফখরুল আমিন বাদল জানান, যেসব শিশু ৩৪ সপ্তাহের আগে ও ১৮০০ গ্রাম ওজনের নিচে জন্ম হয় তাদের জন্য এনআইসিইউ জরুরি। কারণ নির্ধারিত সময়ের আগে বা কম ওজন নিয়ে শিশু জন্ম নিলে স্বাভাবিক তাপমাত্রা সহ্য করতে পারেনা এমনকি স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস ও নিতে পারে না। শূন্য থেকে ২৮ দিন বয়স পর্যন্ত ওইসব শিশুর এনআইসিইউ, স্ক্যানো, এইচডিইউ ছাড়াও ইনকিউবেটর, ভেন্টিলেটর, সিপ্যাপ, ন্যাজালক্যানুলাসহ বিভিন্ন সাপোর্ট সিস্টেম লাগে। এতে ২ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক শিশুর মতো তারা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। সময়মতো এই সেবা দিতে পারলে ৮৮ শতাংশ শিশুর মৃত্যু কমানো যায়। কিন্তু দেশে এনআইসিইউর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তিনি বলেন যে কোনো শিশুর ফুসফুসের সারফেকটেন্ট তৈরি হতে মায়ের জরায়ূতে অন্তত ৩৪ সপ্তাহ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু গর্ভাবস্থায় জটিলতার কারণে বিপুল সংখ্যক শিশু মায়ের গর্ভে আসার সাত মাস অর্থাৎ ২৮ সপ্তাহ পরই কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। এসব নবজাতক পৃথিবীতে এসে যে সার্ভাইভ করবে, এদের হার্টের পরিপূর্ণতা বা পরিপাকতন্ত্রের পরিপূর্ণতা যেটা দিয়ে তারা খাবে- সেটা পরিপক্ক হয় না। এমনকি রোগ প্রতিরোধের যে ক্ষমতা সেটাও সচল থাকে না। তাদের ফুসফুসের ক্রিয়া চলমান রাখতে লাইফ সাপোর্ট প্রয়োজন। এছাড়া খাওয়া-দাওয়া আর পরিপাকতন্ত্র পুরোপুরি গঠন না হওয়ায় টিউবে প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিতে হয়। অথচ এসব নবজাতকের জন্য যে পরিমাণ এনআইসিইউর প্রয়োজন তা খুবই অপ্রতুল। গাইনী ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ডাঃ মালেকা শফি বলছে, মাঠের অভিজ্ঞতা বলছে, শিশুদের অর্ধেকের বেশি জন্ম নিচ্ছে বাড়িতে। বাকিরা হাসপাতাল, ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জন্মানোর সুযোগ পাচ্ছে। বাড়িতে ৯৪ শতাংশ প্রসব হচ্ছে অপ্রশিক্ষিত সেবাদানকারীর হাতে। এ ক্ষেত্রে জটিলতাসহ মা ও শিশু উভয়েরই মৃত্যুঝুঁঁকি বেশি। হাসপাতাল, ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জন্ম নেওয়া শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশ আবার জন্ম নিচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। আর সেখানে প্রসব মানেই অস্ত্রোপচার। অস্ত্রোপচারের পর জটিলতা দেখা দিলেই তারা বড় হাসপাতালে রোগী স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। ফলে প্রায় দেখা যায়, রাস্তায় নবজাতক মারা যায়। তিনি বলেন দেশে প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু জন্মায় কম ওজন নিয়ে। জন্মানোর সময় এদের ওজন থাকে আড়াই কিলোগ্রামের কম। এদের শরীরে তাপ ধরে রাখতে পারেনা। বুকের দুধ টেনে খাওয়ার শক্তি থাকে কম। এসব নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। তিনি বলেন অর্ধেকের বেশি শিশু গ্রামেই জন্মগ্রহণ করছে। সেখানে একটি শিশু অসুস্থ হলে হাসপাতালে আনতে আনতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। আবার অনেক সময় সেখানে এসেও সঙ্গে সঙ্গে পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছে না। তাই নবজাতকের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে এনআইসিইউর সংখ্যা বাড়ানো জরুরী বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, নবজাতকের সমস্যার শুরু হয় অসচেতনতা এবং দারিদ্র থেকে। বিশেষ করে গ্রামের অশিক্ষিত ও দরিদ্র নারীরা প্রশিক্ষণহীন ধাত্রী দিয়ে ডেলিভারী করাতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন। ফলে জন্মের পরই নবজাতকের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। আবার গ্রামে ডেলিভারীর চেষ্টা করে যখন মায়ের অবস্থা খারাপ হয় তখন তাদেরকে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে। আর এর মাঝেই নবজাতকের ক্ষতি হয়ে যায়। আবার নবজাতক অসুস্থ হলেও অনেকেই চলে যান পল্লী চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে দেরীতে আসেন। ফলে তাদের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। এই সব বিভিন্ন সমস্যার কথা চিন্তা করে বুরো বাংলাদেশ বুরো হাসপাতাল নামে একটি পুর্নাঙ্গ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই হাসপাতাল এনআইসিইউ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে টাঙ্গাইলে নবজাতক শিশুদের চিকিৎসার নতুন দ্বার উম্মোচন করেছে। আশা করা যায় বুরো এনআইসিইউ এর হাত ধরে বেসরকারী পর্যায়ে স্বল্প খরচে চিকিৎসা দিতে আরও অনেকেই এগিয়ে আসবেন। এনআইসিইউ এর মতো একটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর চিকিৎসা সেবা শুরু করার মাধ্যমে বুরো হেলথ কেয়ার হাসপাতাল যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে এসেছে তা বিশেষ প্রশংসার দাবীদার।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৬৭ জন হাসপাতালে
ডেঙ্গুতে আরও ৬ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৮৮২
বন্যা পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যা করা উচিত