বিরল উপজেলায় বিরল ফসল ‘শিটি মরিচ’
- শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর
-
২০২৩-০২-২৬ ০৫:১৭:০৪
- Print
‘শিটি মরিচ’ যেমনি ঝাল,তেমনি সৌন্দর্য। দিনাজপুরের ঐতিহ্য,বিরল উপজেলায় দেশের বিরল ফসল এই মরিচ।
আকারে চিকন ও লম্বা ধরনের এ শিটি মরিচের ঝাল,স্বাদ,,রং ও সৌন্দর্যে দেশের যেকোনো এলাকার মরিচের মধ্যে অনন্য।
সরজমিনে দেখা যায়,দিনাজপুর শহর থেকে ৮ কিলো মিটার পশ্চিমে বিরল উপজেলা থেকে দক্ষিণ দিকে পাকা রান্তাটি তিন কিলোমিটার পরই দু’দিকে গাঢ় সবুজের মধ্যে টকটকে লাল রঙের সমারোহ। বিস্তৃর্ণ মাঠে সবুজের ক্ষেতগুলো থোকা থোকা কাঁচা মরিচে ভরপুর। স্থানীয় নাম শিটি মরিচ। শুধু দেখতেই সুন্দর নয়,এর ঝালের বৈশিষ্ট ও খ্যাতি রয়েছে এ মরিচের। জগৎপুর গ্রাম জুড়ে হচ্ছে,এ মরিচের চাষ।কালিয়াঞ্জ-কামদেবপুর সীমান্ত পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামেও বিছিন্ন ভাবে এ জাতের মরিচের চাষ হচ্ছে। শীতে একটু গরমের ওম নিতে কুয়াশায় লুকোচুরি খেলা মিষ্টি রোদের আভায় কৃষক পরিবারের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সরাই একই সংগে আনন্দের সাথে ক্ষেত পরিচর্যার পাশাপাশি তুলছে,মরিচ।
ক্ষেতে কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত পঞ্চাশর্ধো বয়সের মরিয়ম বেগম জানালেন.‘খেতোত ঘাস গাজিছে। বথুয়া শাক হইছে। এ্যাইলা তুলি ফেলাছি,হামরা। এতে মরিচ আরো ভালো হবি।’
পাশে কর্মর্যস্ত এক নারী এসময় হাসি ধরে রাখতে শাড়ীর আচল দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন। মরিয়ম বেগম জানালেন,‘ এইন্না হামার বেটার বহু। ক’দিন আগোত বেহা হইছে। আসিবা বারম কইছুনু। তারপরও হামাক দ্যাখি,ওহ আইছে। বথুয়া শাক কলাছে। বাড়িত নিয়া রান্ধিবি।’
চলতি মৌসুমে জেলায় ভালো ফলন হয়েছে,ঐতিহ্যবাহী ‘শিটি মরিচ’এর। বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে ক্ষেত থেকেই ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন মরিচ। মরিচের দামও ভালো পাচ্ছেন কৃষক।বিলুপ্তপ্রায় এ মরিচ নতুনভা্েব চাষ করে এবার ঘুরছে অনেক কৃষকের ভাগ্যের চাকা।
প্রায় দেড়শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্য এ শিটি মরিচের চাষ ধরে রাখতে জগতপুর,বিষ্ণুপুর,রানীপুকুর, মির্জাপুর,কুকড়িবন,কালিয়াগঞ্জ ও কামদেবপুরসহ বিরল উপজেলার অসংখ্য বৃষক আবারো নতুন করে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মরিচ ক্ষেতের পরিচর্যা,মরিচ তোলা ও বিক্রি নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন,এসব গ্রামের প্রায় পাঁচ শতাধিক কৃষক পরিবার।
বিরল থেকে কালিয়াগঞ্জ-কানদেবপুর যেতে পাকা রাস্তাটি’র দুই দিকেই দিগন্ত বিস্তৃত মরিচের ক্ষেত। বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে ক্ষেত থেকেই ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন মরিচ। কৃষক মরিচের দামও পাচ্ছেন ভালো।ক্ষেত থেকে মরিচ তুলে খালি জমিতে কাঁচা-পাকা মরিচ স্তুপ করে রেখেছেন কৃষকেরা। পাইকারি ক্রেতারা পাল্লায় ওজন করে বস্তজাত করছেন।
মরিচ চাষী আশরাফ আলী জানালেন, তিনি ৪৮ শতক জমিতে শিটি মরিচ চাষ করেছেন। এ জন্য প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। দুুই দফায় ৩৫ মণ কাঁচা মরিচ তুলে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এর পরও জমিতে প্রায় ১০ মণ কাঁচা-পাকা মরিচ আছে।
এলাকার রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত আদর্শ কৃষক মতিয়ার রহমান বলেন, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে জমি থেকে বোরো ধান তোলার পর উঁচু ডাঙ্গা জমিতে শিটি মরিচের চাষ করা হয়। শ্রাবণ মাসে বীজ তৈরির কাজ শুরু হয়। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে চারা রোপণ করা হয়। চারা রোপণের দুই মাসের মধ্যে শুরু হয় মরিচ তোলা। নিবিড় পরিচর্যার পর পৌষ মাসে মরিচ তুলতে পারে কৃষকরা। প্রতি মৌসুমে ফলন্ত মরিচের ক্ষেত থেকে ৩ বার মরিচ সংগ্রহ করা যায়। শতক প্রতি এক মণেরও অধিক মরিচ পাওয়া যায়।মাঘ মাসে মরিচ পেকে পুরো লাল হয়ে যায়।
রানীপুকুর ইউপি সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আযম জানালেন,‘বাপ-দাদাদের আমল থেকে এলাকার কৃষকেরা মরিচের চাষ করেন। মরিচই এলাকার কৃষকদের প্রধান ফসল। আমিও এবার তিন বিঘা জমিতে এ জাতের মরিচ চাষ করেছি। ফলনও হয়েছে ভালো। ইতোমধ্যে ১২ মন মরিচ তুলে বিক্রি করেছি। দাম পেয়েছি,মোটামুটি। তবে.উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মচিরের দাম আরো বেশি হওয়া দরকার।’
শিটি মরিচের চাষ বিষয়ে কৃষিবিদ প্রদীপ কুমার গুহ বলেন, ‘বীজ সংরক্ষণের জন্য ক্ষেতের পাকা মরিচ (টোপা) সংরক্ষণ করে কৃষক। টোপা রোদে শুকিয়ে ড্রামের মধ্যে রেখে বীজ সংরক্ষণ করে তারা। বপনের মৌসুমে প্রতি কেজি বীজ ৮ থেকে এক হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
কামদেপুর গ্রামের মরিচ চাষী রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর আমি ২ বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছি। ফলন ভালো হয়েছে। বিঘাপ্রতি চাষ করতে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছি এবার আমি ৭০ থেকে ৮৫ হাজার টাকার মরিচ বিক্রি করতে পারবো।’
কৃষক মহসীন আলী জানান, ‘শিটি মরিচ চাষে এবার রোগ-বালাই তেমন একটা হয়নি। মরিচের ফলন ও দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে।’
শিটি মরিচের সাথে সাথী ফসল হিসেবে মরিচের পাশাপাশী মুলা, ডাটা, বেগুন, পিয়াজ, রসুন, সরিষা, লাল শাক, পালং শাক, নাফা শাক আবাদ করছেন অনেকে।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অদিদপ্তরের উপ-পরিচালক বৃষিবিদ মো, নুরুজ্জামান জানান, শিটি মরিচের শুধু ঝালই বেশি নয়,এর বৈশিষ্ট্যও রয়েছে অনেক। এটি লম্বায় ৬-৭ ইঞ্চি হয়। একবার গাছ লাগালে ৩ থেকে ৪ বার ফসল সংগ্রহ করা যায়। প্রতি শতকে ১ দশমিক ২৫ মণের অধিক ফলন হয়। হেক্টর প্রতি পাওয়া যায় ১২ টনের অধিক ফলন ।
কিনি জানান, এ বছর ৫৮ হেক্টর জমিতে “বিরলের শিটি মরিচ”সহ দিনাজপুরে দুই’শ ১২ হেক্টর জমিতে এবার মশলাজাতীয় ফসল মরিচ চাষ হয়েছে। রোগ-বালাই তেমন একটা আক্রোমন না করায় এবার মরিচের ফলনও হয়েছে ভালো। শত বছরের ঐতিহ্য বিরলের শিটি মরিচের চাষ ও জাতে গুণমান বজায় রাখতে কৃষক প্রশিক্ষণ ও গবেষণাও অব্যাহত রেখেছে,কৃষি বিভাগ।
কৃষিবিদরা বলছেন,সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহযোগিতা ও পরামর্শ অব্যাহত থাকলে এবং এ শিটি মরিচের ভালো দাম পেলে এ অঞ্চলে মরিচ চাষের পরিধি আরো বেড়ে যাবে।