রূপগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও চনপাড়ার ডন বজলুর রহমান বজলু গ্রেফতারে চনপাড়া পূর্নবাসনের লোকজনের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। জামিনে বের হয়ে এসে আবারো অত্যাচার নির্যাতন করতে পারে এমন শঙ্কায় চনপাড়াবাসীর মাঝে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। চনপাড়া এলাকায় বজলুর বাহিনীর সদস্যরা এখনো দাবড়ে বেড়াচ্ছে। শুক্রবার বিকালে র্যাব-১ এর আভিজানিক একটি দল তাকে চনপাড়া থেকে গ্রেফতার করে। র্যাবের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে, গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে বিদেশী পিস্তল, ম্যাগাজিন, ৫ রাউন্ড গুলি, জাল টাকা উদ্ধার করা হয়। শনিবার (১৯ নভেম্বর) দুপুরে র্যাব-১ এর সদস্যরা বজলুর রহমান বজলুকে রূপগঞ্জ থানায় সোপর্দ করেন।
শনিবার দুপুরে চনপাড়া এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গোটা চনপাড়ায় নীরব-নিস্তব্ধতা। বেশ কিছু দোকানপাট খোলা। মানুষের মাঝে আতঙ্কের ছাঁপ। কথা বলতে এগিয়ে গেলে অনেকে এড়িয়ে যান। বজলু গ্রেফতারের পরও মানুষ বজলুর ব্যাপারে মুখ খুলতে ভয় পান এখনো। দোকান পাট খোলা থাকলেও বস্তির অলি-গলিতে তেমন কোন লোকজন নেই। সবাই আতঙ্কে রয়েছেন এরপর নাজানি কি হয়। বজলু কি জামিনে এসে পড়বে ? অথচ সব সময় বস্তির অলি-গলিতে লোকজনের ভির বা আনাগোনা ছিলো। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বজলু গ্রেফতারে চনপাড়া পূর্নবাসন এলাকায় স্বস্তি নেমে এসেছে। স্থানীয়রা প্রকাশ্যে স্বস্তি প্রকাশ করতে না পারলেও ভেতরে ভেতরে স্থানীয় সাধারণ মানুষ খুব খুশি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, ভাই বজলু গ্রেফতারে আমরা খুশি। চনপাড়ায় শান্তি আইছে। তয় যহন জামিনে বের অইয়া আইলে না জানি কি অয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফার্নিচার ব্যবসায়ী বলেন, আমার দোকানের ছবি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখিয়েছে। আল্লায় জানে জামিনে এসে কি করে। হয়তো মরতে হবে নতুবা লাখ লাখ টাকা গুণতে হবে। আলমগীর হোসেন বলেন, আমি টিভি চ্যানেলে বজলুর ব্যাপারে ওপেন কথা বলছি। ও বের হয়ে আসলে আমাকে মেরে ফেলবে। নাম প্রকাশে কয়েকজন নারী জানান, আমরা চনপাড়ায় শান্তি চাই। চনপাড়ায় আর যেনো মাদক ব্যবসা না হয় আমরা প্রশাসনের কাছে সেটা দাবী জানাই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী জানান, বজলুর মতো লোক আওয়ামীলীগের মতো প্রাচীন ঐতিহ্যবাহি দলে যদি আবার স্থান পায় তাহলে দলের বারোটা বাজবে। চনপাড়ার আওয়ামীলীগকে বজলু শেষ করে ফেলেছে। চনপাড়ার মহিলালীগের এক নেত্রী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, গত এক যুগ ধরে বজলু চনপাড়ায় ত্রাস সৃষ্টি করেছে। তার ও তার বাহিনীর কাছে চনপাড়াবাসী জিম্মি হয়ে পড়েছিলো। খোদ আওয়ামীলীগের লোকজন গত এক যুগ তার হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, গত ১০ টা বছর আমরা অশান্তিতে ছিলাম। বজলু মেম্বারকে টাকা দিয়া ব্যবসা চালাইতে হতো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া একটু শান্তি পাইলাম। তবে ভয়ে আছি। জামিনে আইসা কি জানি করে।
চনপাড়া পূর্ণবাসন কেন্দ্র এলাকার নাম না প্রকাশ শর্তে আরো অনেকেই বলেন, বজলুর রহমান বজলু স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় থাকায় এবং থানা আওয়ামীলীগের নবগঠিত কমিটির কার্যকরি সদস্য হওয়ার পর থেকে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। এরপর বজলুকে বানানো হয়েছে কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অপরাধের নিয়ন্ত্রক হিসেবে চিহ্নিত বজলুকে বিভিন্ন আইনশৃংখলা বিষয়ক সভায়ও করা হতো অতিথি। এ কারনে প্রশাসন ও আইনশৃংলা বাহিনীর কাছে অপরাধ বিষয়ে কোন তথ্য দেননি এলাকাবাসী। এখন বজলু গ্রেফতারে স্বস্থি ফিরে এলেও সাধারন মানুষের মাঝে আতঙ্ক রয়েই গেছে। জামিনে বেরিয়ে এসে ফের আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। এ জন্যই এলাকাবাসীর মাঝে চাপা আতঙ্ক রয়েছে।
চনপাড়া পূর্ণবাসন কেন্দ্র এলাকার কয়েকজন আওয়ামীলীগ কর্মী বলেন, এক সময়ে নুন আনতে পানতা ফুরানো বজলু এখন পিএস, এপিএস, গানম্যান নিয়ে চলে। অপরাধের নিয়ন্ত্রক বলেই সে এভাবে চলতে পারে। বজলুর বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে হামলা-মামলার শিকার হতে হয় স্থানীয় দলীয় কর্মীদের। এ জন্য কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়না। আমরা বজলুকে নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছি। এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরও বজলুর রহমান বজলুকে উপজেলা আওয়ামীলীগের নবগঠিত কমিটির কার্যকরি সদস্য পদ এখনও বহাল রয়েছে। এতে বোঝা যায় অপরাধের নিয়ন্ত্রক বজলুকে কমিটির নেতৃবৃন্দরা এখনও প্রশ্রয় দিচ্ছেন।
এদিকে র্যাব-১ এর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত শুক্রবার (১৮ নভেম্বর) র্যাব-১ এর একটি আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে যে, চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র (চনপাড়া বস্তি) এলাকায় চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী বজলুর রহমান ওরফে বজলু (৫২) অবস্থান করছে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে আভিযানিক দলটি ওই দিন বিকেলে অভিযান পরিচালনা করে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও চনপাড়া বস্তি এলাকার মাদক ব্যবসার মূলহোতা বজলুর রহমান ওরফে বজলুকে গ্রেফতার করে র্যাব। এসময় তার কাছ থেকে ১টি বিদেশী পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন, ৫ রাউন্ড গুলি, ২২০ গ্রাম হেরোইন, ১টি মোবাইল, ভারতীয় ২৫ হাজার জাল রুপি, বাংলাদেশী ৭৫ হাজার জাল টাকা এবং মাদক বিক্রির নগদ ২১ হাজার ৫’শ টাকা উদ্ধার করা হয়।
র্যাব আরো জানায়, গ্রেফতারকৃত বজলুর রহমান@ বজলু (৫২) একজন চিহ্নিত অস্ত্রধারী, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী। সে চনপাড়া বস্তি এলাকার মাদক ব্যবসার অন্যতম মূলহোতা ও নিয়ন্ত্রক। সে দীর্ঘ দিন যাবত মাদক কারবারের সাথে জড়িত। এছাড়া নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলাতে তার বেশ কয়েকজন সহযোগী হিসেবে কাজ করে থাকে। এছাড়াও গ্রেফতারকৃত বজলুর রহমান ওরফে বজলুর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপসহ বিভিন্ন অপরাধে এখন পর্যন্ত ২৩ টি মামলার রেকর্ড পাওয়া গিয়েছে। সে চনপাড়া বস্তি এলাকাসহ আশেপাশের এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ হতে মাসিক ভিত্তিতে টাকা তুলতো বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রটি প্রকৃতপক্ষে চনপাড়া বস্তি নামে অধিক পরিচিত, যেখানে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। অপেক্ষাকৃত নি¤œ আয়ের মানুষ এই বস্তিতে বসবাস করে যার অধিকাংশই দিন মজুর। বিশাল ও অত্যন্ত ঘিঞ্জি এবং ঘনবসতিপূর্ণ এই চনপাড়া বস্তিটি ৯টি এলাকায় বিভক্ত। এই এলাকার শীর্ষ ৫/৬ টি মাদক কারবারীর প্রধান সমন্বয়ক ও গডফাদার ছিলেন বজলুর রহমান ওরফে বজলু। বস্তি এলাকার মাদকের প্রায় ২’শটি স্পট হতে কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বজলু এই ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিল বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া যায়।
র্যাব জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, বজলুর রহমান ওরফে বজলু কায়েতপাড়া ইউপির ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার। সে স্থানীয় উঠতি বয়সের ছেলেদের কাছে বজলু ভাই নামে পরিচিত। বিভিন্ন সোর্স তার ছত্রছায়ায় এলাকার ছেলেদেরকে টাকা প্রদান করে বিভিন্ন প্রকার অপকর্ম যেমন- হত্যা, মাদক বেচাকেনা, চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি, কিশোর গ্যাং, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি এবং পতিতালয় পরিচালনা করে। কেউ চাঁদা না দিলে তার কপালে নেমে আসত নির্যাতনের ভয়াবহতা। এসব আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত এক-দেড় বছরে নিহত হয়েছেন ছয়জন। উল্লেখ্য গত ২০২২ সালোর ২৭ সেপ্টেম্বর অপরাধী গ্রেফতারে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা (র্যাব) চনপাড়া এলাকায় অভিযান চালালে বজলুর রহমান ওরফে বজলুর নির্দেশে অপরাধীরা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর আক্রমণ করে অপরাধী ছিনিয়ে নেওয়ারও অপচেষ্টা চালায়। এছাড়া প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত বজলুর রহমান ওরফে বজলু উল্লেখিত অপরাধের সাথে জড়িত আছে মর্মে স্বীকার করে।
এ বিষয়ে উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক আলহাজ¦ শাহজাহান ভুইয়া বলেন, বজলুর রহমান বজলুর ব্যপারে আগামী বৃহস্পতিবার (২৪ নভেম্বর) সকালে মুড়াপাড়া বাজারে অবস্থিত উপজেলা আওয়ামীলীগের প্রধান কার্যালয় এক জরুরি সভা ডাকা হয়েছে। সভায় উপজেলা আওয়ামীলীগের সকল সদস্যরা উপস্থিত থাকবেন। ওই সভায় বজলুর রহমান বজলুর ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এ ব্যপারে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদ বলেন, বজলুর রহমান বজলুর বিরুদ্ধে র্যাব মাদক, জাল টাকা ও অস্ত্র আইনে পৃথক ৩টি মামলা দায়ের করেছেন। তাকে বিকেলে নারায়ণগঞ্জ আদালতে পাঠানো হয়েছে। ওসি আরো জানান, বজলুর বিরুদ্ধে পুর্বে যেই মামলা গুলো রয়েছে, সবক’টি মামলায় জামিনে রয়েছে। আরো মামলা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।