নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে যে রাজনৈতিক ঐক্য তৈরি হচ্ছে, সেই পথে জাতীয় পার্টিকে জোরালোভাবে পাশে চাচ্ছে বিএনপি। সরকারবিরোধী আন্দোলন সফল করতে অনেকখানি ছাড় দিতেও প্রস্তুত বিএনপি। অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির বড় একটি অংশও চাচ্ছে বিএনপির সাথে যুক্ত হতে। সেই লক্ষ্যে অনেকটাই এগিয়েছে দল দুটি। জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের সম্প্রতিক কিছু বক্তব্যে সেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
জানা যায়, বিএনপি আগামীতে রাষ্ট্রক্ষমতায় এককভাবে যাওয়ার কথা ভাবছে না। যে কারণে নামসর্বস্ব ওয়ান ম্যান পার্টি খ্যাত রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও সরকারের অংশ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। সাংগঠনিক সক্ষমতা ও আসনভিত্তিক সক্ষমতা অনুযায়ী আন্দোলন সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলোর মূল্যায়ন করার কথা বলা হয়েছে সংলাপে। সেক্ষেত্রে প্রথমত প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি নিয়ে জোরালো চিন্তা-ভাবনা চলছে বিএনপিতে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের নেতৃত্ব সংকটের কারণে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আন্দোলন করে বিএনপি। এবার আন্দোলন সফল হলে প্রয়োজনে বিএনপি জিএম কাদের নেতৃত্বে আগামীতে সরকার গঠন করবে। কৌশলগত কারণে জিএম কাদেরকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাবনা দিতে পারে বিএনপি। তবে এর বিপরীত মতামত রয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বিএনপির সঙ্গে কোনো উপায়ে ঘনিষ্ঠ হতে পারে সে বিষয় দলের পক্ষ থেকে সূক্ষ্মভাবে ভাবা হচ্ছে। যেহেতু জাতীয় পার্টি ক্ষমতার সুবিধাবাদী একটি রাজনৈতিক দল সেহেতু তাদের নিয়ে সেভাবেই ভাবা হচ্ছে।
এদিকে জাতীয় পার্টির দলীয় সূত্র জানিয়েছে, আগামী নির্বাচনের জোট ইস্যুতে ইতোমধ্যেই সিনিয়র নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য বাড়তে শুরু করেছেন। এক গ্রুপ চাচ্ছে বিএনপির দিকে ঝুঁকতে, অন্যদল চাচ্ছেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর কষাকষি করে ভাগ বাড়াতে।
জাতীয় পার্টির জিএম কাদেরের বলয়টিও কোনোভাবেই আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে চায় না। তারা ভেতরে ভেতরে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। কারো কারো মতে এ যোগাযোগ বেশ জোরেশোরেই চলছে।
গত ১৯ আগস্ট নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর ছেলে আবরার ইলিয়াসের বিয়ের অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের একই টেবিলে বসার পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে দুই দলের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে নানা গুঞ্জন শুরু হয়।
রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে, সমপ্রতি জিএম কাদের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর সফর করলেও সফরটি ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। ঠিক ওই সময়টাতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য মির্জা আব্বাসসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছিলেন। জিএম কাদের ও মির্জা আব্বাস একই ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন।
সিঙ্গাপুর সফর শেষ করে দেশে এসেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের তার বক্তব্যের ধরন পাল্টে ফেলেছেন। যদিও তিনি অনেকদিন ধরেই বলে আসছেন আমরা আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে নেই। ভবিষ্যতে কোনো জোটে যোগ দেবো তা সময় বলে দেবে।
গত ২০ মে একটি অনুষ্ঠানে জিএম কাদের বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। সবগুলো আসনে ইভিএমে ভোট হলে সরকারদলীয় প্রার্থীরা প্রকাশ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। জাতীয় পার্টি প্রহসনের নির্বাচন চায় না। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে জাপার আগের অবস্থান ছিল বিএনপির ঠিক বিপরীতে। তারা শক্তভাবে তত্ত্বাবধায়কের বিপক্ষে কথা বলতেন। দলটির বক্তব্য ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের সঙ্গে সঠিক আচরণ করেনি। তাই আমরা তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে না। কিন্তু হঠাৎই জিএম কাদের সুর পুরো বদলে ফেলেছেন।
সম্প্রতি এক বক্তৃতায় জিএম কাদের বলেছেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের সামনে প্রশাসন বা সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো অসহায় হয়ে পড়ে। তাই কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আছে। জিএম কাদেরর এসব কথাবার্তা ইঙ্গিতবহ বলে মনে করছেন। সমপ্রতি পদ্মা সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সফল করতে বরিশাল-৬ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পার্টির এক নেতাকে ডেকেছিলেন আবু হাসনাত আব্দুল্যাহ। জাপার ওই এমপি ফোনে জিএম কাদেরর পরামর্শ ও যোগদানের অনুমতি চেয়েছিলেন। জিএম কাদের তাকে সাফ জানিয়ে দেন, কোনোভাবেই অংশ নেওয়া যাবে না। এক পর্যায়ে সাফ জানিয়ে দেন, আবু হাসনাত আব্দুল্যাহর ডাকা সভায় যোগ দিলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। পরে ওই সভায় যোগদান থেকে বিরত থাকেন রতনা আমিন হাওলাদার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাপার একাধিক শীর্ষ নেতা বলেছেন, বিএনপি জোটে ঝুঁকতে সমর্থন বাড়ছে। তৃণমূলের বড় একটি অংশ চান বিএনপির সঙ্গে জোট হোক। এই মতামতে জিএম কাদেরর সঙ্গে গাঁটছড়া রয়েছেন সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব শেখ সিরাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে নির্বাচিত লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি ও অ্যাড. রেজাউল ইসলাম ভূইয়া। এই গ্রুপটি মনে করে, আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে সঠিক আচরণ করেনি। জাপার সমর্থনের কারণে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সাল ক্ষমতায় এসেছিল। এরপর ২০০৮ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় রয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকেও তারা সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত। জাপাকে ভেঙে টুকরো করতে ভূমিকা রেখেছে আওয়ামী লীগ। তাদের ধারণা আগামীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারছে না। তাই তাদের সঙ্গে থাকার কোনো মানে হয় না।
তবে আরেকটি গ্রুপ রয়েছে যারা আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গড়ার পক্ষে। এই মতাদর্শের নেতারা রওশন এরশাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলছেন বলে জানা গেছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপির রাজনীতিতে আসা কিংবা বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টিতে যাওয়া এমন অনেক নেতাদের পরস্পরের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ কিংবা হূদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। পারস্পরিক নানা আলোচনা থেকে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থানও বোঝার চেষ্টা করছেন বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ। যেখানে আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয় রয়েছে বলেও নেতাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ সরকারকে এবার আর ভোট লুট করতে দেবো না। এ কারণে আওয়ামী লীগ ছাড়া আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। সেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে এখন যদি জাতীয় পার্টি শরিক হয়, যুগপৎ আন্দোলনে আসে অবশ্যই আমরা স্বাগত জানাবো। রাষ্ট্র মেরামতের আন্দোলনে যারা আমাদের সঙ্গে আসবে সবাইকেই স্বাগত জানাবো। ক্ষমতাসীনদের বলয়ের সুবিধা থেকে বিরোধী শিবিরে আসবে কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে আহমেদ আজম খান বলেন, এটা তারা বলতে পারবে। যদি তারা বিরোধী শিবিরে আসে, একটা জিনিস আপনি মনে রাখবেন, সাগরে সাঁতরানোর চেয়ে সাগর পাড়ি দিতে হলে আপনি কিন্তু একটা খড়-কুটোর ওপর নির্ভর করতে চান। সেই কারণে কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে সবাইকেই সহযাত্রী হিসেবে চাই। তারা যদি আসে স্বাগত জানাবো। এখন তারা আসবে কি না, কেন আসবে এ প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারবো না। জনগণের মুখের ভাষা তারা বুঝুক। রাষ্ট্রের এ সংকট মুহূর্তে তারা এবং জনগণ আমাদের পাশে দাঁড়াক এটা প্রত্যাশা করি। জনগণ প্রত্যাশা করে, রাষ্ট্র প্রত্যাশা করে।
এসব বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, জাতীয় পার্টি কাদের সঙ্গে যাবে এটা তাদের ব্যাপার। নির্বাচনের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।
জোটবদ্ধ রাজনীতিতে ১৯৯৯ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চার দলীয় জোট গঠনের শুরুতে ছিল এই জাতীয় পার্টি। তবে পরে দলটির তৎকালীন সভাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জোট থেকে বেরিয়ে গেলে তার দলের মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে তখন জাতীয় পার্টির একটি অংশ বিএনপির জোটের সাথে যুক্ত থাকে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে মরহুম কাজী জাফরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির আরেকটি অংশ বিএনপির জোটে আসে। যে দলটি এখনো ২০ দলীয় জোটে রয়েছে।
গত প্রায় ২০ বছর ধরে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির গুরুত্ব বেড়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সাথে মহাজোট গঠনের পর নির্বাচনে অন্যতম নিয়ামক হয়ে ওঠে জাতীয় পার্টি। গত কয়েকটি নির্বাচনে মহাজোটের শরিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে দরকষাকষিও করেছে অনেক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এরশাদের জাতীয় পার্টি এখনো নির্বাচনে অন্যতম ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির ভোট একত্র হওয়ার কারণে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় মহাজোট প্রার্থীদের বিজয় শুধু নিশ্চিতই হয়নি, অনেক সহজও হয়েছে। এরশাদের জাতীয় পার্টি এখনো নির্বাচনে অন্যতম ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে।