দেশের বহুজাতিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস ‘দারাজ বাংলাদেশ লিমিটেড’। আলিবাবা গ্রুপ নিয়ন্ত্রণাধীন দারাজের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। দারাজ বিভিন্ন পণ্য কেনা বা ব্যয়ের বিপরীতে বিপুল পরিমাণ উৎসে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এছাড়া পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এ সুদসহ প্রায় ৭৩ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন ও মামলা করা হয়েছে।
এনবিআর বলছে, দারাজ ‘পরিকল্পিতভাবে’ ভ্যাট ফাঁকি দিতে ভ্যাট রিটার্নে সেবা মূল্য প্রদর্শন করেনি। এছাড়া উৎসে ভ্যাট ফাঁকি দিতে প্রকৃত ব্যয় বা কেনাকাটার তথ্য গোপন করা হয়েছে। এ বিষয়ে দারাজকে দাবিনামাসহ কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। সম্প্রতি এ নোটিশ জারি করা হয়। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে দারাজ বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোস্তাহিদল হকের ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে ফোন দেয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে। পরে ভ্যাট ফাঁকি ও মামলার বিষয়ে বক্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে দারাজের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মো. মাহবুব হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এ বিষয়ে কথা বলবে আমাদের পিআর টিম। তারা কোনো বিষয়ে বলতে বললে আমরা সে বিষয়টি স্পষ্ট করব।’
কনসালটেন্সি ফার্ম জিয়া অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস মামলার বিষয়টি দেখছে বলে জানান দারাজের জনসংযোগ ব্যবস্থাপক সায়ন্তনী তৃশা। এ বিষয়ে জিয়া অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের হেড অব চেম্বার মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমরা শুধু ৫৫(১) পেয়েছি। মামলার প্রতিবেদনের জন্য আমরা ভ্যাট অফিসকে চিঠি লিখছি যে, কোন বিষয়ে ভ্যাট দাবি করা হয়েছে।’
সূত্রমতে, দারাজ বাংলাদেশ লিমিটেড দীর্ঘদিন ধরে পণ্য বিক্রয় এবং প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বা কেনাকাটার বিপরীতে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (উত্তর)-কে নির্দেশ দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম ও ভ্যাট ফাঁকির উদ্ঘাটনে টিম গঠন করা হয়। গঠিত টিম ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর দারাজের প্রধান কার্যালয়ে (আসফিয়া টাওয়ার, হাউজ-৭৬, রোড-১, ব্লক-ই, বনানী) অভিযান চালায়।
সেখান থেকে দারাজের ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মাসিক ট্রায়াল ব্যালান্স, চার্ট অব অ্যাকাউন্টস, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মাসিক বিক্রয় বিবরণী, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত কমিশন রিপোর্ট, ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মাসিক বিপণন খরচ বিবরণী, একটি ল্যাপটপ, মাসিক দাখিলপত্রের কপি ও কমিশন হারের কপি জব্দ করা হয়। পরে এসব দলিলাদি পর্যালোচনা করে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন ও মামলা করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯-২০ অর্থবছর ৪০টি খাতে প্রায় ৩৭৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয় বা কেনাকাটা করেছে। যার বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে মূসক প্রায় ৫৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। যার মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৬ কোটি ২১ লাখ টাকা পরিশোধ করলেও বাকি প্রায় ৪৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। এর ওপর ২ শতাংশ হারে সুদ প্রায় ৯৭ লাখ টাকা। সুদসহ ফাঁকির পরিমাণ প্রায় ৪৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এছাড়া ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি যে সেবা সরবরাহ করেছে, তার বিপরীতে প্রযোজ্য ভ্যাট ছিল প্রায় ১৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। এর ওপর ২ শতাংশ হারে সুদ প্রায় এক কোটি টাকা। সুদসহ মোট ফাঁকি প্রায় ১৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি অনলাইনে পণ্য বিক্রয় এবং সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দাখিলপত্রে প্রদর্শিত প্রাপ্ত সেবা মূল্য অপেক্ষা কম প্রদর্শন করে পরিকল্পিতভাবে ১৫ কোটি ৬২ লাখ ১১ হাজার ১৩৯ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এছাড়া একই সময় ৪৮ কোটি ৫২ লাখ ৩৬ হাজার ২৩১ টাকার উৎসে মূসক ফাঁকি দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি মোট ৬৪ কোটি ১৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৭১ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। ফাঁকি দেয়া মোট ভ্যাটের ওপর ২ শতাংশ হারে সুদের পরিমাণ প্রায় ৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। সুদসহ মোট ফাঁকির পরিমাণ প্রায় ৭২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ফাঁকি দেয়া ভ্যাট পরিশোধে সম্প্রতি ভ্যাট ঢাকা উত্তর কমিশনার সই করা দারাজ বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানকে লিখিত জবাব দিতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ৩০ মে প্রতিষ্ঠানকে শুনানিতে ডাকা হয়েছে। অন্যথায় মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে নোটিশে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেন, দারাজের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ ছিল। ইতোমধ্যে ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন ও দুটি মামলা করা হয়েছে। তবে সঠিকভাবে কাগজপত্র পাওয়া গেলে ফাঁকির পরিমাণ আরও বেড়ে যেত। প্রতিষ্ঠানটি পরিকল্পিতভাবে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে। ফাঁকি উদ্ঘাটনের পর এ প্রতিষ্ঠানে নজরদারি বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, দারাজ চীনা মালিকানাধীন একটি অনলাইন মার্কেটপ্লেস, যেটি দক্ষিণ এশিয়ায় কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এটি ২০১২ সালে জার্মান কোম্পানি রকেট ইন্টারনেটের মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৫ সালে ‘দারাজ বাংলাদেশ’ নামে বাংলাদেশে দারাজের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৭ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা ই-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ‘কেইমু’ দারাজের সঙ্গে একীভূত হয়। ২০১৮ সালের ৯ মে আন্তর্জাতিক দারাজ গ্রুপকে চীনা বহুজাতিক কোম্পানি ও ই-বাণিজ্য জায়ান্ট আলিবাবা গ্রুপ কিনে নেয়। আলিবাবা গ্রুপ নিয়ন্ত্রণাধীন দারাজ বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, হংকংসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দারাজ, শপ ও লাজাডা নামে ই-বাণিজ্য সেবা দিয়ে থাকে।