চিটাগং সিনিয়রস ক্লাব দেশের অভিজাত ও ধনিক শ্রেণির ক্লাব। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত এ ক্লাবের বিরুদ্ধে রাজস্ব (ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক) ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে ক্লাবের কনফারেন্স রুম, সেলুন, গেস্ট হাউস, জিমনেশিয়াম, বেকারি, সুইমিং পুল, বিনোদন, খাবার প্রভৃতি সেবার বিপরীতে এ বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হয়েছে। ক্লাবের বারে বিক্রি করা মদে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া পাঁচ বছর ধরে ক্লাবের ব্যয় বা কেনাকাটার বিপরীতে কোনো উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করা হয়নি।
পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটির মোট প্রায় আট কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটন ও মামলা করেছে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট। সম্প্রতি পরিদর্শন, তল্লাশি ও যাচাই শেষে রাজস্ব ফাঁকির প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে ক্লাব কর্তৃপক্ষ বলছে, রাজস্ব ফাঁকি হয়নি। কোথায়, কীভাবে, কত শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়, তা ভ্যাটের কর্মকর্তারা কখনও এসে বুঝিয়ে দেননি।
সূত্রমতে, চট্টগ্রামের জামাল খান রোডে অবস্থিত চট্টগ্রাম সিনিয়রস ক্লাব। এ ক্লাবের বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ পায় এনবিআর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের নির্দেশে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট একটি ‘নিবারক দল’ গঠন করে। নিবারক দল গোয়েন্দা নজরদারি করে এর সত্যতা পায়।
পরে নিবারক দল চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম পরিদর্শন ও তল্লাশি করে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সিএফও মো. ইমতিয়াজ ইসলাম নিবারক দলকে দলিলাদি দিয়ে সহযোগিতা করেন। নিবারক দল তল্লাশি করে পাওয়া ও প্রতিষ্ঠানের দেয়া কাগজপত্র প্রাথমিকভাবে যাচাই করে গরমিল দেখতে পায়। পরে কাগজপত্র জব্দ করা হয়, যা যাচাই করে বিপুল পরিমাণ ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়। এ বিষয়ে মামলা করে ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারকে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে পণ্য বিক্রি ও সেবা সরবরাহের ওপর প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসাব করা হয়। এতে দেখা যায়, এসময় চিটাগং সিনিয়রস ক্লাব মোট প্রায় ২৭ কোটি ৬১ লাখ টাকার সেবা সরবরাহ করেছে, যাতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক প্রায় এক কোটি ৮৪ লাখ টাকা, যার মধ্যে এক কোটি ৭৮ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। মূলত মদ ও সিসা বিক্রির বিপরীতে এই সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করা হয়নি। চিটাগং সিনিয়রস ক্লাব লিমিটেডের অনুমোদিত বার রয়েছে। এতে সদস্যদের জন্য মদ আমদানি ও সংগ্রহ করা হয়। বারে সরবরাহ করা মদের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক প্রযোজ্য। এছাড়া ওই পাঁচ অর্থবছরে প্রযোজ্য ভ্যাট প্রায় তিন কোটি ৬০ লাখ টাকা, যার মধ্যে তিন কোটি ৩৮ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়নি।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, চিটাগং সিনিয়রস ক্লাব একটি লিমিটেড প্রতিষ্ঠান। ফলে এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী, এই ক্লাবের বিভিন্ন পণ্য কেনাকাটা বা ব্যয়ের বিপরীতে উৎসে ভ্যাট প্রযোজ্য। চিটাগং সিনিয়রস ক্লাব লিমিটেড ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত যে পরিমাণ ব্যয় বা কেনাকাটা করেছে, তাতে প্রযোজ্য ভ্যাট প্রায় দুই কোটি ৫৮ লাখ টাকা। কিন্তু ক্লাবের পক্ষ থেকে ওই পাঁচ অর্থবছরে কেনাকাটা বা ব্যয়ের বিপরীতে কোনো ধরনের উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করা হয়নি। অর্থাৎ চিটাগং ক্লাব ওই পাঁচ অর্থবছরে ক্লাবের যেসব সেবা সরবরাহ করে, তার বিপরীতে তিন কোটি ৩৭ লাখ ৯১ হাজার ৬৬৭ টাকার ভ্যাট, এক কোটি ৭৭ লাখ ৬৯ হাজার ৩৭৮ টাকার সম্পূরক শুল্ক ও দুই কোটি ৫৭ লাখ ৭১ হাজার ৭৫৭ টাকার উৎসে ভ্যাটসহ মোট সাত কোটি ৭৩ লাখ ৩২ হাজার ৮০৩ টাকা রাজস্ব পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। মূসক আইন অনুযায়ী, ফাঁকি দেয়া ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কের ওপর দুই শতাংশ হারে সুদ প্রযোজ্য। সুদসহ হিসাব করা হলে ফাঁকির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।
এ বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘দেশের অভিজাত ও ধনিক শ্রেণির ক্লাবগুলো সঠিকভাবে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করে না। চিটাগং সিনিয়রস ক্লাব লিমিটেড এর মধ্যে অন্যতম। এসব ক্লাবের ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আদায়ে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। এরপরও মাঠ কর্মকর্তারা ফাঁকি উদ্ঘাটন ও আদায়ের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’
এ বিষয়ে চিটাগং সিনিয়রস ক্লাবের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মো. ইমতিয়াজ ইসলাম বলেন, ‘২০১৪ সাল থেকে আমরা ভ্যাট দিই। এর আগে ক্লাবে ভ্যাট ছিল না। আমরা পাঁচ হাজার টাকা করে ভ্যাট দেয়া শুরু করেছি, এখন এক লাখ টাকা দিই।’ ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘কোন খাতে কত ভ্যাট হবে, কীভাবে ভ্যাট দিতে হবে, কোন খাতে ভ্যাট দেয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে জানাতে ভ্যাটের কর্মকর্তারা কখনও ক্লাবে আসেননি, কিংবা আমাদের ডেকে কখনও বলেননি। এখন কেন বলছেন ভ্যাট ফাঁকি হয়েছে?’
তিনি আরও বলেন, ‘ক্লাবে তিন শতাধিক সদস্য কেনাকাটা, ক্লাবে খাবার ও মদ খাওয়া, বিনোদন সব করে। বাইরের কেউ এখানে আসার সুযোগ নেই। ক্লাব তো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়। এর পরও আমরা ভ্যাট দিতে রাজি। কিন্তু ভ্যাটের কর্মকর্তারা এতদিন কেন আসেননি? আমরা কেন ভ্যাট ফাঁকি দেব? এখন আমরা বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে যাব।’