মানুষ ভুলে যাচ্ছে জীবনের মৌলিকত্ব

এস এম শামসুজ্জোহা, রাজশাহী : || ২০২৪-০২-১২ ১৩:০০:৩৫

image
দেশে দীর্ঘ সময় ধরে চলমান অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে দুর্নীতিবাজ এবং বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বাজারে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে; যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। দেশে নিত্যপণ্যের উৎপাদনে কোনো ঘাটতি নেই। সরবরাহব্যবস্থাও স্বাভাবিক। এরপরও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে পাগলা ঘোড়ার গতিতে। পাশাপাশি সব ধরনের সেবার মূল্যও বাড়ছে বেপরোয়া গতিতে। এতে ভোক্তার জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে লাগামহীনভাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মানুষের আয়ের সাথে ব্যয়ের সমন্বয় না থাকায় ভুলে যেতে বসেছেন জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর মৌলিকত্ব। এসবে জন্য একমাত্র দায়ী বাজার সিন্ডিকেট কারসাজির সঙ্গে জড়িত বেশকিছু দাপুটে চক্র। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সিন্ডিকেটের কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে একটি চক্র। তারা প্রতি বছর ভোক্তাকে জিম্মি করে হাজার কোটি টাকা ছিনিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ওই চক্রের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। এভাবেই নির্বিঘ্নে দাপুটে উত্থান ঘটছে বাজার সিন্ডিকেটের। তথ্য মতে, ডলারের লম্ফঝম্প, বিশ্ববাজারে পণ্যের দামে ওঠানামা, আমদানি সংকট, চাঁদাবাজিসহ নানা যুক্তি দাঁড় করিয়ে নিত্যপণ্যের বাজার গরম রাখছে অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট। সবসময় দাম বাড়ার পেছনে কুশীলব হিসেবে তারা থাকে পুরোভাগে। প্রভাবশালী চক্র হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয় না কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আলোচনাতেই থেমে যায় বাজার নিয়ন্ত্রণের তোড়জোড়। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনামলে প্রায় সব পণ্যের দর হয়েছে কয়েক গুণ। এ পরিস্থিতিতে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে লাগাম টানতে দর বেঁধে দেওয়া, অভিযান, জরিমানাসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কারসাজি চক্রকে দমানো যায়নি। অতীতে সিন্ডিকেটের সামনে কখনও খোদ বাণিজ্যমন্ত্রীকেই অসহায় বোধ করতে হয়েছে। সরকারেরই কোনো কোনো মন্ত্রী বলছেন, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে চাঁদাবাজি বন্ধ করা জরুরি। এ নিয়ে অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারপ্রধান ভূমিকা নিচ্ছেন এটা ইতিবাচক। তবে জনবান্ধব নীতি প্রণয়ন না করলে কিংবা অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত না হলে বাজার অনিয়ন্ত্রিতই থেকে যাবে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে। তারা বলছেন, সরকার ব্যবসাবান্ধব হলে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙবে কীভাবে? কারা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত; তা সরকারের সংস্থাগুলো জানে। এ চক্র ভাঙতে হলে সরকারকে প্রত্যক্ষভাবে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে হবে। সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে সরকারকে হতে হবে জনবান্ধব। আর জনবান্ধব তখনই হবে- যখন জনস্বার্থে মুদ্রানীতি, জ্বালানিনীতি, ব্যবসানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজার ও সিন্ডিকেট সম্পর্কে মন্ত্রী পর্যায়ে এ ধরনের কথায় সাধারণ জনগণ হতাশ হয়ে যান। অন্যদিকে যারা সিন্ডিকেট করেন তারা আরও উৎসাহবোধ করেন। তারা ভাবেন আমরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের চোখের জল ফেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী যদি সিন্ডিকেটে হাত দিতে না পারেন; তাহলে যে কাজটি করতে পারেন সেটি হলো-যারা সিন্ডিকেট করেন; তাদের তো সরকার চেনে ও জানে। কাজেই তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে সরকারি যেসব নীতিসহায়তা আছে, সেগুলো কমিয়ে দিতে পারেন। অনুসন্ধ্যানে জানা যায়, বাজার কারসাজি ও সিন্ডিকেটের ভয়াল থাবায় আজ দেশের জনজীবন বিপর্যস্ত। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে দৈনন্দিন জীবনের অনেক প্রয়োজন কাটছাঁট করেও জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জীবনের বোঝা আজ বড্ড ভারী হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ জীবনের মৌলিকত্ব ভুলে গেছে। মানুষ আজ অসহায় হয়ে পড়েছে; জিম্মি হয়ে পড়েছে দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান সিন্ডিকেটের হাতে। তেল থেকে বেল, ওষুধ থেকে বিষ, ডাল থেকে চাল, ধান থেকে পাট, আলু থেকে জিরা, পেঁয়াজ থেকে আদা, ডিম থেকে আটা, খাতা থেকে বই, কলম থেকে বেতন, ইট-পাথর-রড-বালু কোনো কিছুই বাদ নেই। যেখানেই সিন্ডিকেটের হাত পড়েছে, সেখানেই ছড়িয়েছে আগুন। সেই আগুনের তাপেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে মানুষের দেহ-মন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, উৎপাদন খরচ নেই, কিংবা যেসবের উৎপাদন খরচ একেবারেই কম, সেসবের দাম কীভাবে আকাশছোঁয়া হয়, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। সরকারের বেঁধে দেয়া দামে বাজারে মিলছে না ডিম, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি। সরকারের বেঁধে দেয়া দামকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাচ্ছে সিন্ডিকেট ও করপোরেট ব্যবসায়ীরা। আর সেইসঙ্গে পালে হাওয়া তুলেছে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, লুটপাটকারী ও টাকা পাচারকারী ঋণখেলাপিরা। ধান থেকে চাল, চাল থেকে তেল-চামড়া, চামড়া থেকে পেঁয়াজ, পেঁয়াজ থেকে চাল ও মৌসুমি সবজিসহ সবখানেই সিন্ডিকেটের কারসাজি। এই সিন্ডিকেট আমাদের উন্নয়ন এবং অর্জনগুলোকে দিনের পর দিন প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে। দেশে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, এক ধরনের কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে এবং গুজব রটানোর মধ্য দিয়ে চোখের সামনে দিনের আলোয় পকেট কেটে নিয়ে যায় আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকা। অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশিষ্টজনরা বলছেন, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ার বিকল্প নেই। বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যাদের, তারা যদি ব্যর্থ হন, তাহলে তাদের পদ থেকে সরে যাওয়া উচিত। তারা বলছেন, ভোজ্যতেল, চিনি, ডিম, ব্রয়লার মুরগিসহ বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ৫ থেকে ৬টি করপোরেট কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে ক্রেতারা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কেনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মূল্যবৃদ্ধির কারসাজির সঙ্গে যেসব বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান বা করপোরেট কোম্পানি জড়িত সেগুলোকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আদতে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রথম কাজ বিকল্প সরবরাহ নিশ্চিত করা। বাজার দিয়ে বাজারের মোকাবিলা করা। একই সঙ্গে কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে যে বিধান রয়েছে তার মাধ্যমে অপরাধীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া। এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে; আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এ অসাধু চক্রকে বাজার কারসাজিতে নিরুৎসাহিত করতে হবে। বাজারে প্রভাব বিস্তারকারীদের আইনের আওতায় আনাই মুখ্য বিষয় বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন । তিনি বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এক, পণ্য উৎপাদন, মজুত ও চাহিদার যথাযথ তথ্য সরবরাহ ও বিশ্লেষণ। দুই, চাহিদা অনুযায়ী জোগান ঠিক আছে কিনা। ঘাটতি থাকলে সেটি কীভাবে পূরণ করা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা নেওয়া। তিন, পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার পেছনে যাদের হাত থাকে; দক্ষ ও যোগ্য লোক দিয়ে তদন্ত করে সঠিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করা। সেই সঙ্গে প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হবে, তারা প্রভাবশালী হলেও আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। তবে বাজারে অভিযান, জরিমানা আর দর বেঁধে দেওয়া– এগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার নয় বলে মনে করেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হাঁকডাক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তারা শুধু মূল্য নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করতে পারে। বাজারের লাগাম টানার মূল অস্ত্র অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে। কারণ দাম সহনীয় রাখতে হলে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। আর এ ভূমিকা রাখতে পারে অর্থ মন্ত্রণালয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে গত এক বছরের মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী এবং ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে গত মে মাসে (৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ)। একই মাসে গত বছরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। আগস্টে খাদ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাক জাতীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। ২০২০ সালে খাদ্য খাতে ১০০ টাকার পণ্যে ৫ টাকা ৫৬ পয়সা বৃদ্ধি হয়েছিল। একই পণ্যে ২০২৩ সালের নভেম্বরে বেড়েছে ২০ টাকা ৫৪ পয়সা। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিগত সময়ে সরকার ১০০টির বেশি সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু সুফল পাচ্ছে না, সুবিধাবঞ্চিত অনেক মানুষ। অর্থাৎ তিন কোটির বেশি মানুষ নূন্যতম নাগরিক সুবিধার অনেকটাই বঞ্চিত। আর অতি দারিদ্র্যের কাতারে বসবাস করছে দেশের প্রায় ৬ শতাংশ মানুষ। এমনকি চিকিৎসা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও কৃচ্ছ্রসাধন চলছে। শহর ও গ্রামের মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে; গ্রামে এর ধকল বেশি। গ্রামাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অন্যদিকে শহরের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এটা হচ্ছে আমাদের সার্বিক মূল্যস্ফীতির চিত্র। অন্যদিকে প্রান্তিক আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সবার আগে আমলে নিতে হয়। বিশ্বব্যাংক বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে পারলে এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক করা সম্ভব হলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে।

Editor & Publisher: S. M. Mesbah Uddin
Published by the Editor from House-45,
Road-3, Section-12, Pallabi, Mirpur
Dhaka-1216, Bangladesh
Call: +01713180024 & 0167 538 3357

News & Commercial Office :
Phone: 096 9612 7234 & 096 1175 5298
e-mail: financialpostbd@gmail.com
HAC & Marketing (Advertisement)
Call: 01616 521 297
e-mail: tdfpad@gmail.com