একটি কম্বলের জন্যে সারারাত অপেক্ষায়

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর: || ২০২৪-০১-১৪ ০৮:৫৪:৫৬

image
"একখান কম্বলের ব্যবস্থা করি দেইস বা।হাত-পালা ককড়া লাগি আইসেছে। বরফ হই গেইছে, গাওটা। একখান কম্বলের জন্যই অপেক্ষায় আছো বা। কম্বল পাইলেই বাড়ি চলি যাম।" শনিবার রাত সাড়ে ১২ টায় দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশন চত্বরে একটি শীতবস্ত্র কম্বলের জন্যই এমনি আকুতি করছিলেন, কোহিনুর বেগম। ষাটোর্ধ বয়সের কোহিনুরের বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার আমবাড়ী এলাকায়।গত দুইদিন থেকে অবস্থান করছেন,রেল স্টেশন এলাকায়,একটি কম্বলের আশায়। স্বামী নেই।মারা গেছে অনেক আগেই। এক ছেলে থাকলেও তার কোন খবর নেই। এক মেয়ে আছে,বিয়ে হয়েছে। স্বামী ছেড়ে চলে গেছে। স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ের দুই সন্তান আছে। তারা তিনজনেই এখন কোহিনুরের ঘাড়ে। দেড় বছরের ছোট নাতনির জন্যই তার একটা কম্বল দরকার।শুনেছেন,রেল স্টেশনে রাতে অনেকে কম্বল দেন।তাই সেই কম্বল পেতে তিনিও এসেছেন ২১ কিলো মিটার পারি দিয়ে। দু'রাত থেকে অপেক্ষা করছেন, কম্বল পেতে। যাত্রীদের কাছে চেয়ে যা টাকা পেতেছেন,সেই টাকা দিয়ে রাতে শাক আর রুটি খেয়েছেন। শুধু কোহিনুর বেগম নয়, মসলেমা, রমিছা, মাজেদা, সোহানা, বিলকিস, রোজিনা, আকলিমা, রাবেয়া, পারুল, ফাতেমা, মজিদ,মোকসেদ, রমজান, সতেন্দ্র, মকবুল, মমিনুল আবুল কালাম, দিদ্দিক, ফজলা, কমলা কান্ত, আদাদুল্লাহ সহ অনেকেই একটি কম্বলের জন্যে রেল স্টেশন চত্বরে অনেক রাত অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। এনিয়ে দু'একজনের এ প্রতিবেদক কথা বলতে গেলে বেশ কয়েকজন বয়স্ক নারী-পুরুষ ঘিরে ঘরে। তাদের ধারনা কম্বল দেয়ার জন্য হয়তো তালিকা করতে কেউ এসেছে। বুঝে ওঠার আগেই এক নারী আবেদন জানালো " বাবা রে হামাকেও একখান কম্বল দেন,বাবা। তোমার পাও খান ধরো-হামাক একখানা কম্বল দেন। কতো কষ্ট করিয়া এই স্টেশন পরি আছো। ঠাকুরগাঁও এর পীরগঞ্জ থাকি আইছু বাপ। একখান কম্বল কেহ দিলেনা। জাড়োত কাপেছো।বুড়া মানুষ হায়ও। হানার ভিতি কেউ দেখেওনা। হামাক একখান কম্বল দাও বা! " একটি কম্বলের জন্য তিনি গত ১৩ দিন থেকে দিনাজপুর রেল স্টেশনে অবস্থান করছেন। তিনি ষাটোর্ধ এই নারীর নাম মোসলেমা বেওয়া। এ বছর একটি ভালো কম্বল পাননি তিনি। বিগয় বচ্ছরে যেগুলো পেয়েছেন সেগুলোর গুণগত মান একদম ভালো না। নষ্ট হয়ে গেছে। এমনটাই মন্তব্য তার। রাহেলা খাতুন (৪৫) নামে একজন নারী জানালেন, আমিও একটি ভালো কম্বল নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছি। ভাড়া থাকেন,শহরের উপ-কন্ঠ হঠাৎপাড়ায়। রাহেলা জানালেন, 'স্টেশনে থেকে এ পর্যন্ত তিনি দু'টো কম্বল পেয়েছি।কিন্তু কোনো ভালো কম্বল পাইনি। যে দুটো পেয়েছি সেগুলো অনেক হালকা। ওই কম্বল দিয়ে শীত নিবারণ করা সম্ভব নয়।' মজিবর রহমান (৬৫) নামে রংপুর পীরগাছা এলাকার একব্যক্তি জানালেন, একটি ছেলে রয়েছে তার। তবে সেই ছেলে মা-বাবাকে দেখাশোনা করে না। বিয়ে করে পৃথক থাকে। তাউ তিনি মানুষের কাছে চেয়ে যা পান,তাই দিয়ে চলেন। তিনিও একটা কম্বলের আশায় আছেন।পেলেই বাড়ি যাবেন।এই ঠান্ডায় কম্বল ছাড়া বাড়ি যাওয়া যাবেনা বলেও জানান তিনি। শুধু যারা চেয়ে খান বা ভিক্ষাবৃত্তি করেন,তারাই শুধু নয়,রাতের আঁধারে রেল স্টেশনে অনেকেই এসে বসে থাকে একটি ভালো কম্বলের আশায়। এরা অধিকাংশই বস্তি এলাকার বাসিন্দা। এমনি একজন কুলসুমা বেগম। তিনি জানালেন, 'শুধু আমি না এনেকেই আসি বসি থাকে। রাইত পার করি দেয়,একখান কম্বলের তইন্নন্যে।কিন্তু যেসব কম্বল দেওয়া হয়, সেগুলো নেওয়ার মতো না।’ মখলেসুর (৪৮) নামে একজন জানালেন, ‘শুধু আমি না, দিনাজপুর শহরে যারা বস্তিতে বসবাস করে; তারাই রাতের আঁধারে স্টেশনে এসে বসে থাকে, একটি ভালো কম্বলের জন্য।' প্রসঙ্গগত:হাঁড় কাপানো কনকনে শীত আর হীমেল হাওয়ায় জবুথবু অবস্থা উত্তরের জনপদ দিনাজপুরে। শীতের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। আজ রবিবার (১৪ জানুয়ারি) দেশের সর্বোনিন্ম তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে দিনাজপুরে। যা এ জেলায় এ মৌসুমে সর্বোনিন্ম তাপমাত্রা বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া বিদরা। দিনাজপুরের উপর দিয়ে মৃদু শৈত প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে জেলার আঞ্চলিক আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান। তিনি জানিয়েছেন,চলমান শীতের তীব্রতা কমার কোনো সম্ভবনা নেই। হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যেই ১৮ এবং ২৯ জানুয়ারি বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। গত চার দিন ধরে শীতের প্রচণ্ডতায় জনজীবন মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিশেষ করে শ্রমজীবী নিন্ম আয়ের মানুষের বেহালদশা। প্রয়োজন ছাড়া অনেকে বের হচ্ছে না ঘর থেকে। শীত আর ঘন কুয়াশায় উত্তরের শষ্যভান্ডারে কৃষি উৎপাদন সবজি চাষেও চরমভাবে ব্যাঘাত ঘটছে। এই শীতের তীব্রতায় গবাদিপশু-পাখিসহ প্রাণিকুলের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।মানুষ বেচা-কেনার হাট বলে খ্যাত দিনাজপুরের ষষ্টিতলার শ্রমবাজারে শীতে কাবু শ্রমজীবী মানুষ। গত কয়েক দিনে অধিকাংশ সময় সূর্যের আলো দেখা যাইনি। ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীতের মধ্যে যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। দিনের বেলাতেই সড়কে হেড লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। দিনের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় রাস্তায় মানুষের চলাচল কমেছে। উষ্ণতার আশায় মানুষ খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শরীর গরম করে নিচ্ছেন।দিনের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায়, বেশি বিপাকে পড়েছেন, খেটে খাওয়া ও নিম্ন আয়ের মানুষ। শীতজনিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল,অরবিন্দু শিশু হাসপাতালে শীতজনীত রোগির সংখ্যা বাড়ছে। হিমেল হাওয়ার সঙ্গে জেঁকে বসা শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। কনকনে শীত আর হিমেল হাওয়ায় চরম বিপাকে এ অঞ্চলের শীতার্ত মানুষ। শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছিন্নমূল মানুষদের দুর্দশাও বেড়েছে। দিনভর কনকনে ঠান্ডা বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে পথে-প্রান্তরে থাকা ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র মানুষগুলোকে। খোলা আকাশের নিচে থাকা এ হতদরিদ্র মানুষগুলো শীতে নাকাল হয়ে পড়েছেন। একটু উষ্ণতার খোঁজে পথের পাশে খড়কুটো কুড়িয়ে আগুন জ্বেলে ঘিরে বসে থাকছেন তারা। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে নিম্ন আয়ের মানুষ ভিড় করছেন পুরোনো শীতবস্ত্রের গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানের লন্ড্রি বাজার হকার্স মার্কেটে । আর সামর্থ্যবানরা দৌড়াচ্ছেন অভিজাত মার্কেট ও শপিংমলে। হালে তাই শীতবস্ত্রের কেনাবেচাও জমে উঠেছে। হাড় কাঁপানো শীতের মাস ‘মাঘ’। যে শীত তীব্র শক্তির বাঘকেও হার মানায়। তাই পৌষের শেষলগ্নে এ যেন বিদায়ের আগে প্রকৃতিকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এদিকে দিনাজপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় জেলার শীতার্ত মানুষের শীত লাঘবে ২০ হাজার পিস কম্বল চেয়ে মন্ত্রাণাললে জরুরি ফেক্সবার্তা পাঠানো হয়েছে।

Editor & Publisher: S. M. Mesbah Uddin
Published by the Editor from House-45,
Road-3, Section-12, Pallabi, Mirpur
Dhaka-1216, Bangladesh
Call: +01713180024 & 0167 538 3357

News & Commercial Office :
Phone: 096 9612 7234 & 096 1175 5298
e-mail: financialpostbd@gmail.com
HAC & Marketing (Advertisement)
Call: 01616 521 297
e-mail: tdfpad@gmail.com