কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র স্টাফ নার্স রিকতা আখতার বানু রোগীদের স্বাস্থ্যসবায় নিয়োজিত আর কখনো রোগীকে করেনি অবহেলা। নিজের কন্যা প্রতিবন্ধী তানভীন দৃষ্টিমনি (ব্রহ্মপুত্র) কে লেখাপড়ার জন্য বিদ্যালয়ে পাঠান। অথচ স্কুল থেকে ব্রহ্মপুত্রকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই বেদনাবোধ থেকেই রিকতা আখতার বানু ব্রহ্মপুত্র মেয়েসহ সমাজের অবহেলিত প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার জন্য ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে ২০০৯সালে গড়ে তোলেন রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। বাক শ্রবণ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে এই শিক্ষায়তন থেকে। ২০১০সাল থেকে বিদ্যালয়ে নিয়মিত পাঠদান ও সাফল্য অর্জন করায় সরকারিভাবে ২০২০সালে এমপিওভুক্ত হয়। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বেতন পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সু-শিক্ষা প্রদান করে আসছেন। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক বলছেন বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে মুগ্ধ হয়েছি এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল ধরনের সহায়তা করা হবে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র স্টাফ নার্স রিকতা আখতার বানু সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত। তারপরেও থেমে নেই তার জীবন সংগ্রাম। ১৯৯৯সালে রিকতার কোল জুড়ে আসে প্রতিবন্ধী কন্যা তানভীন দৃষ্টিমনি (ব্রহ্মপুত্র)। তার প্রতিবন্ধী ব্রহ্মপুত্র কন্যাকে লেখাপড়ার জন্য ২০০৭সালে বিদ্যালয়ে পাঠালে তিন বছরের মধ্যেই স্কুল থেকে ব্রহ্মপুত্রকে তিনবার প্রতিবন্ধী বলে তাড়িয়ে দেয়া হয়। পুনরায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাকে ভর্তির চেষ্টা করেন রিকতা। অনেক অনুরোধের পর তানভীন দৃষ্টিমনি ব্রহ্মপুত্রকে ভর্তি করানোর কয়েকদিনের মধ্যেই তাকে আর পড়াতে চাননি শিক্ষকরা। সেই বেদনাবোধ থেকেই রিকতা আখতার বানু তার স্বামী আবু তারিক আলমের ২৬শতক জমিসহ তার সহায়তায় প্রতিবন্ধী ব্রহ্মপুত্র মেয়েসহ চরাঞ্চলের অবহেলিত প্রতিবন্ধী শিশুদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে ২০০৯সালে গড়ে তোলেন রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। বাক শ্রবণ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের বিশেষায়িত শিক্ষাসহ আটিজমে আক্রান্তদের সমাজের মুল ধারায় ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। বিদ্যালয়ে প্রায় তিন শত শিক্ষার্থীদের আধাপাকা ভবনে চলছে পাঠদান। স্কুলস্টাফ ৪৩জনের মধ্যে ২০জন শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত হয়ে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন এবং অবশিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারী ২৩জন বেতন না পাওয়ার পরেও স্কুলে পাঠদান করেই যাচ্ছেন। ফলে তারা পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এদিকে ভবন ও আসবাবপত্র সংকট থাকাসহ শিক্ষা উপকরণ ও গাড়ি না থাকায় শিক্ষাদানে কষ্ট হচ্ছে। আবাসিক ভবনের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সম্প্রতি থানাহাট, ডাওয়াইটারি, জোড়গাছ, গুরাতিপাড়া, সরকারপাড়া, মুদাখৎ থানা, শরিফেরহাট, মাচাবান্দসহ ব্রহ্মপুত্রপারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা আসে এই স্কুলে এবং অনেক শিক্ষার্থীরা আসে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূর থেকে। তাদের আনা-নেওয়ার জন্য রয়েছে তিনটি ভ্যান। অভিভাবক ও স্থানীয়দের কাছে বিদ্যালয়টি তাদের শিক্ষার আস্তা। পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দুর থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার জন্য রয়েছে তিনটি ভ্যান। প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় স্কুলটিতে।
পাঠদানে স্বেচ্ছাশ্রম: শাহীন শাহ, রুজিনা, মহসিন ও লতিফা আক্তার নামের চারজন শিক্ষক স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে এক সময় প্রতিবন্ধীদের প্রাথমিক পাঠ দিতেন। এখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২১জন শিক্ষক-কর্মচারী শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে কাজ করছেন। নানা কৌশলে শেখাচ্ছেন পড়াশোনা। পাশাপাশি ফেসিয়াল মাসাজ, স্পিচ থেরাপিসহ নানা থেরাপির মাধ্যমে এগিয়ে নিচ্ছেন এই শিশুদের। প্রধান শিক্ষক শাহীন শাহ জানান, খেলার সামগ্রী এবং আরো কিছু সরঞ্জাম দরকার তাঁদের। প্রয়োজন নিয়মিত প্রশিক্ষণের। এখানে বিশেষ ধরনের শিক্ষা দেয়া হয়। তবে একীভূত শিক্ষার ব্যবস্থা না করলে সমাজের মূলধারায় জায়গা করে নিতে এই শিশুদের সমস্যা হবে। বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মচারী ৪৩জনের মধ্যে ২০জন শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত এবং ২৩জন শিক্ষক-কর্মচারী বেতন না পাওয়ার পরেও স্কুলে পাঠদান করেই যাচ্ছেন। ভবন ও আসবাবপত্র সংকট থাকাসহ শিক্ষা উপকরণ ও গাড়ি না থাকায় বিপাকে তারা। তাই কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি জরুরি।
মায়ার এক ভুবন: ৬৩জন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীকে নিয়ে যাত্রা শুরু হয় স্কুলটির। তখন শিক্ষার্থীদের দুপুরের নাশতার টাকা এবং অন্যান্য খরচ জোগাতে রিকতা বানু সংসারের বাজেট কাটছাঁট করেছিলেন। স্কুলটি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর শিক্ষক-কর্মচারীরা সেই দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁরা চাঁদা দিয়ে শিক্ষার্থীদের দুপুরের নাশতা দেন। তবে এখনো সপ্তাহের এক দিন আর বিশেষ দিনে নাশতা কিংবা দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেন রিকতা বানু। শিশুদের তিনি মায়ের আদরে বড় করছেন। সহকারী শিক্ষকরা বলেন, আটিজমে আক্রান্তদের সমাজের মুল ধারায় ফিরিয়ে আনতে সমাজের অবহেলিত প্রায় তিন শত জন প্রতিবন্ধী শিশুকে পাঠদান কার্যক্রম চলছে। স্কুলটি এমপিওভুক্ত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। প্রতিষ্ঠানটিতে আবাসিক ভবনের দাবি তাদের।
রিকতা ও তারিকের কথা: রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) এর কথা, এরা সবাই আমার সন্তান। এদের জন্য সব সময় মন কাঁদে, মায়া লাগে। তবে আমার স্বামী পাশে না থাকলে এত দূর আসা সম্ভব হতো না। ২০০৯সালে আমার স্বামী আবু তারিক আলমের সহযোগীতায় স্কুলটি নির্মিত হয়ে শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে সাফল্য অর্জন করায় ২০২০সালে এমপিওভুক্ত হয়। ভবন ও আসবাবপত্র সংকট থাকাসহ শিক্ষা উপকরণ ও গাড়ি সংকট। রিকতার স্বামী ও চিলমারী ইউএনও মনোনীত বিদ্যালয়ের সভাপতি আবু তারিক আলম বলেন, আমার ২৬শতক জমিতে সমাজের অবহেলিত প্রতিবন্ধী শিশুদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে ২০০৯সালে তার গড়ে তোলা হয় রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ে প্রায় তিন শত শিক্ষার্থীদের আধাপাকা ভবনে চলছে পাঠদান। আবাসিক ভবনের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
নয়ন জুড়ে স্বপ্ন আর: রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) এর কন্যা প্রতিবন্ধী তানভীন দৃষ্টিমনি (ব্রহ্মপুত্র) এখন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। কথা বলতে না পারলেও সব সময় মিষ্টি হাসি লেগে থাকে তার ঠোঁটে। এখন নিজের কাজ, বাড়ির কাজ আর পড়াশোনার কিছু কাজ নিজেই করতে পারে। অন্য শিশু-শিক্ষার্থীদেরও অনেকেই ধীরে ধীরে জড়তামুক্ত হচ্ছে, শিখছে কথা বলা। পঞ্চম শ্রেণির ক্লাসের আল আমিন বুদ্ধি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। আগে কিছুই বলতে পারত না সে। স্পিচ থেরাপিসহ শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় এখন ছড়া পাঠ, কোরআন তিলাওয়াতসহ লেখাপড়ায় তার আগ্রহ শিক্ষকদের আশা জাগাচ্ছে। মোস্তফার মা ও বাবা দুজনই প্রতিবন্ধী। তার পরও থেমে নেই তার শিখন কার্যক্রম। আরেক শিক্ষার্থী নাজমা আখতার লাকি বলে, আগে পাঁচ টাকা চিনি নাই, এখন চিনি। শিক্ষার্থী সাদিয়া আখতারের মা রেশমা বেগম বলেন, চিলমারীতে প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো স্কুল নেই। রিকতা আপার স্কুলটিই আমাদের ভরসা।
অন্তহীন স্বপ্ন: রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) এর স্বপ্ন দেখেন তাঁর স্কুলটি হবে আবাসিক। দূর-দূরান্ত থেকে শিশুরা এখানে আসবে। হাতে-কলমে শিক্ষা নিয়ে সমাজের মূলস্রোতে মিশবে অবহেলিত সেই শিশুরা। বর্তমানে বাতজ্বরে কাবু হয়ে বেশির ভাগ সময় বিছানায় কাতরান রিকতা বানু। চাকরি আর সংসারের বোঝা টানতে চরম বেগ পাচ্ছেন। তারপরও অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে দেখেন আলোর হাতছানি। মৃত্যুর আগে তিনি স্বপ্নের স্কুলটির আরো প্রসার চান, হাসি ফোটাতে চান আরো অনেক মলিন মুখে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে মুগ্ধ হয়েছি এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল ধরনের সহায়তা করা হবে।
Editor & Publisher: S. M. Mesbah Uddin
Published by the Editor from House-45,
Road-3, Section-12, Pallabi, Mirpur
Dhaka-1216, Bangladesh
Call: +01713180024 & 0167 538 3357
News & Commercial Office :
Phone: 096 9612 7234 & 096 1175 5298
e-mail: financialpostbd@gmail.com
HAC & Marketing (Advertisement)
Call: 01616 521 297
e-mail: tdfpad@gmail.com