মহামারিকালেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অপরিবর্তনীয় থাকে কীভাবে?

নিজস্ব প্রতিবেদক: || ২০২০-০৮-১৪ ২৩:১০:৩৩

image

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি যে আনুষ্ঠানিক ড্যাটা বা উপাত্ত প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, জুনে শেষ হওয়া গত অর্থবছরে দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.২৪ শতাংশ। করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার পর সবচেয়ে বাজে এ সময়ে এটিকে একটি 'দারুণ খবর' হিসেবেই ধরা উচিত।

এটিকে 'দারুণ খবর' বলা উচিত; কেননা, জুনে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি উড়ন্ত ৮.১৫ শতাংশ থেকে কমে মাত্র ১.৬ শতাংশে নেমে আসার যে ভীতিকর পূর্বাভাস বিশ্বব্যাংক দিয়েছিল, এই প্রবৃদ্ধি হার সেটিকে অস্বীকার করেছে।

কিন্তু বিবিএসের দেওয়া ওই উপাত্তে সত্যিকারের দারুণ খবর হয়ে ওঠার দম নেই।

প্রবৃদ্ধির উপাত্ত হিসেব করার ক্ষেত্রে গত অর্থবছরের শেষ কোয়ার্টার বা ত্রৈমাসিককাল- এপ্রিল থেকে জুন- এই তিন মাসে মহামারিটির কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে থাকার যে প্রভাব, সেটি পরিমাপ করেনি।

গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের অর্থনৈতিক ধরন এটি পরিমাপ করেছে। সেই তথ্যের ওপর ভর করে, এটি শেষ তিন মাস- এপ্রিল থেকে জুনের অর্থনৈতিক পারফরম্যান্স বা কর্মক্ষমতার হিসেবে করেছে, যে তিন মাস অর্থনীতি ছিল শাটডাউন।

যে কোনো স্বাভাবিক সময়ে বিবিএস সাধারণত এই পদ্ধতির প্রয়োগ করে। কিন্তু বর্তমান অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকটের এই সময়ে সেটি প্রয়োগ করা মোটেও যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।

শাটডাউনের সময়ে, এই প্রেক্ষাপটের বাস্তবতা ছিল ভয়াবহ। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে একটি ব্যাপকমাত্রার সংকোচন ঘটে গেছে। চাকরিচ্যূত হয়ে লাখ-লাখ মানুষ উপার্জন হারিয়েছেন; আর তৈরি হয়েছে জাতীয় দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা।

প্রতিটি খাতই বিরাট লোকসানের মুখে পড়েছে। জুনের শেষে শাটডাউন উঠিয়ে নেওয়ার পর থেকে সেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য লড়ে যাচ্ছে ব্যবসা খাত। আগামি কয়েক বছরেও অবস্থা পুনরুদ্ধার করতে না পারার আশঙ্কা পেয়ে বসেছে এর অনেকগুলোকেই।

এ সবই কোনো অর্থনীতির মন্দার মুখোমুখি হওয়ার একেকটি লক্ষণ।

তবু, বিবিএস যেহেতু সেই প্রভাবের পরিমাপ করেনি, তাই শাটডাউনের কারণে অর্থনীতির ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা অজানাই রয়ে গেল।

এই ধাক্কা থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ঘটানোয় সাহায্য করতে সরকার নানাবিধ পরিমাপ হাতে নিয়েছে। একটা উপমা টেনে বলা যায়, এ যেন রোগের পরীক্ষা না করেই ওষুধ লিখে দেওয়া।

প্রথম নয় মাসের অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতার ভিত্তিতে বিবিএস যে উপাত্ত হাজির করেছে, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। এটি স্পষ্টভাবেই ইঙ্গিত দেয়, মহামারিটি আক্রমণ করার আগে থেকেই আমাদের অর্থনীতি একটি পতনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল।

আগের, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশ রেকর্ড ৮.১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিবন্ধভুক্ত করেছিল এবং পরবর্তী অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৮.২ শতাংশ।

কিন্তু বিবিএসের সর্বশেষ উপাত্ত জানান দিচ্ছে, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি মাত্র ৫.২৪ শতাংশ- যা কি না গত ১৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল হার। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫.২ শতাংশে নেমে আসার যে অনুমান অর্থ মন্ত্রণালয় গত জুনে প্রকাশ করেছিল, এই উপাত্ত সেটিই মেনে চলেছে।

গত কয়েক বছরে গড়ে ৭ শতাংশের আশেপাশে থাকা একটি অর্থনীতির জন্য এটি সত্যকার অর্থেই এক বিপত্তি।

এই দুর্বলতার লক্ষণগুলো বেশ আগেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। মহামারিটির প্রাদুর্ভাবের যথেষ্ট আগে থেকেই আমদানি-রপ্তানি ও বেসরকারি খাতের ক্রেডিট বৃদ্ধির মতো প্রধান ম্যাক্রোইকোনোমিক সূচকগুলো একটি নিম্নমুখী প্রবণতার মুখোমুখি হয়েছিল।

তাছাড়া, বিবিএস যেহেতু অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতার ত্রৈমাসিক হিসেব করেনি, তাই ঠিক একই কারণে, প্রথম তিনটি ত্রৈমাসিককালের অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতার সঠিক চিত্রও অজানাই রয়ে গেছে। অর্থনীতি ঠিক কী রকম স্লোডাউনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, সেটি বোঝানোর গুরুত্বপূর্ণ কোনো উপাত্ত এখানে নেই।

এখন, অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে অন্ধকারে থেকেই সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বর্তমান অর্থবছরে ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির উচ্চাকাঙ্ক্ষি হার নির্ধারণ করে একটি ভি-আকৃতির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশা করছেন। তাছাড়া, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক অর্থনীতি একটি অভূতপূর্ব সংকোচনে ভুগছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির অত্যাশ্চর্যজনক ৯.৫ শতাংশ সংকোচন ঘটেছে; এ এক ঐতিহাসিক সংকোচন, এবং এত অল্প সময়ে কী পরিমাণ ক্ষতি যে তাদের হয়েছে- সেটির এক যন্ত্রণাদায়ক বিজ্ঞপ্তি। দেশটির বার্ষিক জিডিপির হার সংকোচিত হয়েছে ৩২.৯ শতাংশ, কী অকল্পনীয় কথা!

ইউরোপের পরিস্থিতিও রক্ত হিম করে দেওয়ার মতো। ইউরো-অঞ্চলের অর্থনীতি দ্বিতীয় ত্রৈমাসিককালে এক অভূতপূর্ব পতনমুখী হয়ে এমন গভীর গর্তে ঢুকে গেছে, যেখান থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে বেশ কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। ১৯ সদস্য দেশের ওই অঞ্চল সামগ্রিকভাবে ১২.১ শতাংশ সংকোচনের দেখা পেয়েছে।

তারা জানে তাদের অর্থনীতি কী ক্ষতির মুখে পড়েছে এবং তারা একটি মন্দার ভেতর পড়তে যাচ্ছে। ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করতে তথ্য-উপাত্ত তাদের নীতিনির্ধারকদের সাহায্য করছে।

সামনের দিনগুলোতে বৈশ্বিক স্লোডাউন আমাদের রপ্তানি খাতকে ক্ষত-বিক্ষত করবে, আর তার ফলে আমাদের অর্থনীতিকে হিমশীতল ভোগান্তির শিকার হতেই হবে।

শাটডাউনের সময়ে ইতোমধ্যেই ব্যাপকমাত্রার সংকোচনের মুখোমুখি এটি হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য অর্থনীতির মতো সেটির কোনো সঠিক চিত্র আমাদের কাছে নেই। বিবিএস কর্মকর্তারা বলছেন, লকডাউনে অর্থনীতির ওপর কী প্রভাব পড়েছে, সেই উপাত্ত তারা ডিসেম্বর নাগাদ হয়তো দিতে পারবেন। সেই মূল্যায়ন হয়তো প্রবৃদ্ধির হার পর্যালোচনায় সাহায্য করবে। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কাজে লাগার প্রশ্নে সেটি অনেক বেশি দেরি হয়ে যাবে।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, নির্ভুল ও সময়োপযোগী অর্থনৈতিক উপাত্ত বিশেষত কোনো সংকটকালে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে। বিশ্বাসযোগ্য উপাত্ত ছাড়া নীতিনির্ধারকদের পক্ষে পরিমাপ করা সম্ভব নয়- মহামারিটি জনগণ ও অর্থনীতিকে কতটা মারাত্মক আঘাত করছে; এমনকি তারা পুনরুদ্ধার পর্যবেক্ষণও যথাযথভাবে করতে পারবেন না।

অবশ্য, ভাইরাসটির হাজির করা অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকটের ধরন বিবেচনা করে অর্থনীতির ত্রৈমাসিক কর্মক্ষমতা পুনঃমূল্যায়ন করার কোনো পরিকল্পনা বিবিএসের নেই।

তিন বছর আগে, ত্রৈমাসিক অর্থনৈতিক উপাত্ত প্রকাশের একটি উদ্যোগ নিয়েছিল বিবিএস। সেই সেই উদ্যোগ এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

'পৃথিবীর অনেক দেশই অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতার ত্রৈমাসিক উপাত্ত প্রকাশ করে,' বিবিএসের মহাপরিচালক তাজুল ইসলাম সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ কথা বলেছেন। 'আমাদেরও তা-ই করা উচিত। ভবিষ্যতে এটি বিবেচনা করে আমরা পরিমাপ করব।'

সরকারের নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

Editor & Publisher: S. M. Mesbah Uddin
Published by the Editor from House-45,
Road-3, Section-12, Pallabi, Mirpur
Dhaka-1216, Bangladesh
Call: +01713180024 & 0167 538 3357

News & Commercial Office :
Phone: 096 9612 7234 & 096 1175 5298
e-mail: financialpostbd@gmail.com
HAC & Marketing (Advertisement)
Call: 01616 521 297
e-mail: tdfpad@gmail.com