চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নব্বর্ষে দিনাজপুর মাতোয়ারা
শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর ||
২০২৩-০৪-১৪ ০৪:৫৬:১২
চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নব্বর্ষ মানেই উত্তরের সীমান্ত ঘেষা জেলা দিনাজপুরের মানুষ নবরূপে একাত্ম হয়ে বিশেষ কৃষ্টির মহিমায় রূপায়িত হওয়া। আনন্দে মেতে ওঠা। বছর বছর ধরে এজেলায় জাতিধর্মনির্বিশেষে এ দিনটি বিশেষ আড়ম্বরের সঙ্গে উদযাপিত হয়ে থাকে। দিনাজপুর জেলাবাসী নিজ মেধা, মনন ও চিন্তা দিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে পালন করে নববর্ষের নানা অনুষ্ঠান।
আজ শুক্রবার পহেলা বৈশাখের দিনে বিরামপুরে বসেছে তিন'শ বছরের ঐতিহ্যবাহী মণ্ডপের মেলা।
এমেলায় যেমন উৎসবমুখর করে তোলে, তেমনই প্রাণের সঞ্চার হয় অনেকের। এ মেলা উপলক্ষ্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠে একশ্রেণির পেশাজীবী মানুষ। তারা রাতদিন কষ্ট করে মেলা ও বৈশাখীর উপকরণ তৈরি করে। মেলায় পাওয়া যায় কারুপণ্য, কৃষিজাত দ্রব্য, লোকশিল্প জাত জিনিস, কুটিরশিল্পসামগ্রী, খেলনা, নারীদের সজ্জাসামগ্রী, চিড়া, মুড়ি, খই, বাতাসা, চিনির সাজসহ নানা কিছু।
জ্ঞানবিজ্ঞান, মানস ভাবনা, সাহিত্য-সংগীত
প্রতিফলিত হয় মেলায়।এমেলার মাধ্যমে প্রকাশ পায় বাঙালির নিজস্ব সত্তা ও স্বকীয়তা।
বিরামপুর সদর থেকে মাইল খানেক দূরে মির্জাপুর গ্রামের বসেছে এ মেলা।
তিন'শ বছরেরও বেশি পুরোনো, প্রায় হাজার দশেক মানুষের এক বিপুল-বর্ণাঢ্য আনন্দ-সমাবেশ এটি। জয়পুরহাট,নওগাঁ, গাইবান্ধা জেলার নানা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ সেখানে আসে। এমনকি সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও অনেক মানুষ এসে যোগ দেয় এই মেলায়। মির্জাপুর জামলেশ্বর শিবমন্দির ঘিরে চৈত্রসংক্রান্তির দিন সকাল থেকে শুরু হয় মেলাটি,জনশ্রুতিতে এটা ‘মণ্ডপের মেলা’।
উত্তরবঙ্গের বিরাট এক অংশের মানুষ এক সময় লেপ-তোশক তৈরির জন্য শিমুলতুলা সংগ্রহ করতে আসত এই মেলায়। শিমুলতুলার সংবৎসরের পাইকারি কেনাবেচারও অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল এই মেলা।বিক্রি হয় উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত মিষ্টিআলু, হলুদ, মরিচ, রসুন, মৌরি। মাটির তৈরি তৈজসপত্র: হাঁড়ি-পাতিল, ঘড়া, মটকা, সানকি, কলস ইত্যাদি। লোহার তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রী: ছুরি, কাঁচি,দা, কোদাল, কাস্তে, লাঙলের ফলা ইত্যাদি। কাঠের আসবাব যুক্ত হয়েছে এমেলায়।
মুলত: এ মণ্ডপ মেলায় পাওয়া যায় আবহমান বাংলার লোকজ শিল্প। শিল্পের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় মাটি, মানুষ ও দেশের পরিচয়।
এ মেলা স্থাপত্য, লোক ও কারুশিল্প, আর্থসামাজিক অবস্থারও ইঙ্গিতবাহী।
কবে কোথায় মেলার গোড়াপত্তন হয়েছিল, তা জানা না গেলেও প্রায় তিন'শ বছরের ঐতিহ্য এ মেলা বলে জানালেন,মন্দিরের পুরোহিত রতন রায়।
পহেলা বৈশাখের আগের দিন অর্থাৎ চৈত্রের শেষ দিনে পালিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি, এদিনে জেলা সদর, ফুলবাড়ী, চিরিরবন্দর, ঘোড়াঘাট সহ জেলার বিভিন্ন উপজলায় বসে বারোয়ারি মেলা। পান্তাভাত ও ইলিশ খাওয়ার রেওয়াজ চালু থাকলেও এজেলার গ্রামচঞ্চলের মানুষ এখন আর্থিক অনটনের কারণে ইলিশের নাগাল না পেয়ে পাটা শাক,সজনে ডাটা,পেঁয়াজ-মরিচ, দিয়ে পান্তা খেয়ে নববর্ষের সূচনা করে থাকে।
তবে গ্রামে এখনো ভেষজ রস, নাড়ু, মোয়া, মুড়ালি, খাজা, চিড়া, দই, গুড়, বাতাসা ইত্যাদি খাবার খেয়ে দিনের সূচনা করা হয়। কোথাও কোথাও এখনো আয়োজন হয় নানা ধরনের খেলাধুলার। বাজানো হয় ঢোলকসহ নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। এই দিনে আনন্দ করে শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবাই।
বাংলা নববর্ষে গ্রামবাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির অংশ বৈশাখী মেলা যুগ যুগ ধরে দিনাজপুরে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে চলেছে। তবে,এবার মাহে রমজান ও ঈদের কারণে দিনাজপুরের গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানে বসছে না, বৈশাখী মেলা। দিনাজপুর জেলা প্রশাসন ও বৈশাখী উদযাপন কমিটি যৌথভাবে এ মেলার আয়োজন করে থাকে। ঈদের পর এমেলা বসার কথা রয়েছে। যদিও নারী-শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ সবাই অপেক্ষা করে আছে বৈশাখী মেলার বিশেষ দিনের জন্য।তবে তারিখ নির্ধারণ হয়নি বলে জানিয়ে দিনাজপুর জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট এর সভাপতি সুলতান কামাল উদ্দীন বাচ্চু।
চরক পুজা ও বৈশাখী উৎসবের অর্থ সংগ্রহের জন্য জন্য প্রতি বছর জেলার ফুলবাড়ীতে কেউ সাজে কালী, কেউ দূর্গা, কেউবা শিব আবার কেউবা রাধা-কৃষ্ণ। এমনি বিভিন্ন দেবদেবীর রূপে বাদ্যের তালে তালে নেচে-গেয়ে পূজো অর্থ সংগ্রহসহ ভক্তদের পূজার জানান দেয় সনাতন ধর্মাবলম্বীর ৮ থেকে ১২ জনের একটি দল। এমন দৃশ্য চোখে পড়ে ফুলবাড়ী পৌরবাজারসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে।
বর্ণিল সাজে নানা দেবদেবীর রূপে ৮/১২ জনের একটি দল বাদ্যের তালে তালে নেচে-গেয়ে ঘুরে বেড়ায়। দলের বেশির ভাগ সদস্য কিশোর, তরুণ ও যুবক। তাঁরা বাড়ি ও দোকানে গিয়ে মঙ্গল কামনা করে ধর্মীয় এবং নৃত্য পরিবেশন করে। গান পরিবেশনের পর ওইসব সনাতনী গৃহস্থ ও দোকানীরা তাঁদের চাল, ধান, ডাল, সবজিসহ নগদ অর্থ দেন।
দেবদেবীর রূপ ধারণকারী তারা সকলে ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও আলাদীপুর চরক কালী মন্দির কমিটির সদস্য।
শ্মশান পিতা ভোলানাথ (শিব) ও কালীমাতা আদ্য শক্তি কৈলাশ থেকে শ্মশান মত্যধামে আগমন উপলক্ষে আলাদীপুরে এই চরক কালী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ৪ বৈশাখ সোমবার রাত্রী ১২.৩০ মিনিটে হবে শ্মশান যাত্রা, ৫ বৈশাখ মঙ্গলবার রাত্রী ২.৪৭ মিনিটে কালী পূজো এবং ৬ বৈশাখ বুধবার চরক পূজো ও মেলা।
আলাদীপুর চরক কালী মন্দিরের সভাপতি পরিতোষ চন্দ্র রায় ও সম্পাদক কান্তি চন্দ্র সরকার বলেন, প্রতিবছর বৈশাখ মাসে এই চরক পূজো ও মেলার আয়েজন করা হয়। এটি প্রাচীন পূজা। চরক ঘুরবে এবং মন্দিরের আশপাশে মেলা বসবে। সেখানে একজনের পিঠে গাঁথা হবে বর্শি। এরপর ঘোরানো হবে চরকে। সেই সঙ্গে হবে পূজা-অর্চনা। এটি দেখতে বিভিন্নস্থান থেকে মানুষের উপড়ে পড়া ভিড় জমে। সেই পূজোকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন দেবদেবীর রূপে সেজে আমরা অর্থ সংগ্রহসহ মানুষকে পূজো সম্পর্কে জানান ও নিমন্ত্রণ জানাই।
এ পুজা ও মেলাকে ঘিরে আনন্দের সীমা নেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। আয়োজন করা হবে চড়ক পূজা ও মেলার। চড়ক পূজা ও গ্রামীণ মেলায় থাকবে মানুষের উপচে পড়া ভিড়।
থাকবে ঢাকঢোল বাজনার সঙ্গে উলুধ্বনি। হাত জোড় করে ভগবানের কাছে মঙ্গল কামনা করবে সবাই।
অন্যদিকে চৈত্রসংক্রান্তিতে দিনাজপুরের সদর উপজেলার শেখপুরা ইউনিয়নের উত্তর গোপালপুর এলাকার দুর্গা শিব মন্দিরের পাশের মাঠে চড়ক পূজা ও গ্রামীণ মেলায় এ দৃশ্য দেখা গেছে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মোমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, শত শত বছর ধরেই এই মেলা হয়ে আসছে। চড়ক মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে চিরিরবন্দর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায়।
হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজা ও গ্রামীণ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। চড়ক পূজাসহ সেখানে বসেছিল দিনব্যাপী গ্রামীণ মেলা। চড়ক উৎসবটি দেখতে সেখানে বিভিন্ন বয়সী কয়েক হাজার ভক্ত ও দর্শনার্থীদের সমাগম ঘটে। ছিল উপচেপড়া ভিড়।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর দৌলতপুর ইউপির পলিপাড়া ডাঙ্গা শ্রী শ্রী কালী মন্দির চত্বরে এ চড়ক মেলার আয়োজন করা হয়।
মেলায় দেখা যায়, হাজার হাজার মানুষের অপলক চোখ ৩০ফুট উচ্চতার কাঠের দণ্ডের দিকে। একজন মানুষ শূন্যে ঘুরছেন একটি দড়িতে ঝুলে। দড়িটি বাঁধা ওই মানুষটির পিঠের চামড়ায় গাঁথা বড় দুটি বড়শির সাথে। চলছে উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি। বাজছে ঢাকঢোল। ঘুড়ানো হচ্ছে কাঠের দণ্ডটি। আর তাতেই ঝুলে চারিদিকে গোল চক্কর খেলেন অরবিন্দ চন্দ্র রায় (৪৬) নামের এক ব্যক্তি। তার সঙ্গে থাকা ফুল-জল, আবির, কলা, বাতাসা, নকুলদানা ইত্যাদি ছিটিয়ে দেন অগণিত ভক্ত-দর্শকের দিকে। অরবিন্দ রায় দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পৌরএলাকার চাঁদপাড়া গ্রামের মতিলালের ছেলে।
আয়োজকরা জানায়, বড়শিতে বিদ্ধ মানুষকে ঘোরানোর আগে সারাদিন ধরে নানা আচার পালন করা হয়। মানুষ ঘূর্ণনের জন্য পোতা কাঠের দণ্ডটি মাঠের মাঝখানে বসানো হয়। অনেকটা লাঙলের জোয়ালের মতো, আরেকটি কাঠ এই কাঠের ওপর লম্বালম্বিভাবে বসানো। কাঠের মাথায় থাকে মাটি পর্যন্ত ঝোলানো কয়েকটি লম্বা দড়ি। কাঠের দণ্ডের ঠিক নিচে একদল মানুষ শক্ত হাত দিয়ে ঘোরান দড়িগুলো। এটাই চড়ক পূজার মূল আকর্ষণ।
চড়ক পূজার উৎসবে আসা লক্ষী রানী রায়, গৌরাঙ্গ, মহন্তসহ কয়েকজন বলেন, এই চড়ক মেলা উপলক্ষে পুরো গ্রাম উৎসবে মেতে ওঠে। রাতে পূজো হয়। দিনে মেলা হয়। মেলাসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ মেলা শেষ পর্যন্ত আর হিন্দু সম্প্রদায়ের মেলা থাকে না। এটা মিলনমেলায় পরিণত হয়।
কাজীহাল ইউনিয়ন থেকে আসা প্রধান শিক্ষক চন্দন কুমার রায় বলেন, প্রতিবছর এখানে চৈত্র মাসের শেষে পূজা উপলক্ষে চড়ক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবকে ঘিরে সপ্তাহব্যাপী চলে নানা আয়োজন। দিনব্যাপী গ্রামীণ মেলা বসে, নানা প্রকার খাবারের দোকান বসে। পরিবার-পরিজন নিয়ে উৎসবটি উপভোগসহ মায়ের আরাধনা করতে এসেছি।
বড়শিতে ঝুলে থাকা অরবিন্দ চন্দ্র রায় বলেন, দীর্ঘ ১১বছর থেকে দেশের বিভিন্নস্থানে এই কাজ করছেন তিনি। তার পিঠে অগণিত ছিদ্র রয়েছে। প্রত্যেকবার পিঠের ভিন্ন ভিন্নস্থানে ছিদ্র করে বড়শির কল লাগানো হয়। এটি করতে বেশ সাধনার প্রয়োজন।
উৎসব আয়োজক পলিপাড়া ডাঙ্গা শ্রী শ্রী কালী মন্দিরের সভাপতি সোহেল চন্দ্র রায় বলেন, চৈত্র মাসের শেষে চড়ক কালীপূজোর আয়োজন করা হয়। এই পূজো ও চড়ক উৎসবকে কেন্দ্র করে দিনব্যাপী মেলা বসেছে। এতে কয়েকে হাজারো ভক্ত ও দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে।