"শীতে নদীতে নামতে কষ্ট হয়, তারপরও জীবন বাঁচাতে যাই"

শাহাদাত হোসেন শান্ত, চাঁদপুর || ২০২২-১২-১৪ ১০:৫০:১৬

image
ইমন অন্যান্য দিনের মত তার নির্দিষ্ট ক্রেতাদের কাছে নিজের ধরা কাঁকড়া গুলো নিয়ে বিক্রি করতে না পেরে আশাহত মন নিয়ে কাঁকড়ার কলশি নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁকড়া গুলো বিক্রি করতে না পারলে পঁচে যাবে। কাঁকড়া বিক্রির টাকা না পেলে তার পড়ার খরচ মেটানো যাবে না এবং মায়ের হাতে চাউল কেনার জন্য টাকা দিতে পারবে না। এই বিষন্নতা নিয়ে সে তার নিজ বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে লঞ্চ ঘাটের দিকের যাচ্ছিল। বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক সেলিনা আক্তারের চোখে দৃশ্যটি ধরা পড়ে। সেলিনা আক্তার ইমনকে স্কুলে ডেকে আনার পর তার বিষন্নতার কারণ জানার পর বিষয়টি আমাকে অবহিত করে। গত ৬ ডিসেম্বর দুপুরে নিজ কর্মস্থল চাঁদপুর চাঁদপুর শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমন একটি হৃদয় বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ার পর ইমনের বেদনা বিধুর শৈশব জীবনের কষ্টের কথা গুলো শুনে আবেগ আল্পুত হয়ে অশ্রুসিক্ত হই। সমাজের শ্রমজীবী, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের জন্য শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট (সাবেক পথ কলি ট্রাস্ট) পরিচালিত চাঁদপুর শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০০৬ সাল থেকে চাকুরি করার সুবাদে এধরণের হৃদয় বিদারক ঘটনার বহু স্বাক্ষী হচ্ছি প্রতিনিয়তই। কিন্তু এদিনের ঘটনাটি আমাকে ভাবিয়েছে গরিবের স্কুলটিকে ধ্বংস করতে সাবেক শিবির নেতা শিক্ষক নামের কুলাঙ্গার, কুচক্রীসহ কতিপয় দালাল, চাটুকার, তদবিরবাজ শিক্ষক নেতা, এবং চরিত্রহীন, লম্পট, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার নানাহ ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করে দায়িত্ব অবহেলা ও দুর্নীতিতে বিধ্বস্ত বিদ্যালয়টিকে বাঁচাতে প্রাণপণ লড়াই করার কষ্ট ও বেদনার কিছু ক্ষতবিক্ষত স্মৃতি মনে করে। ছিন্নমূল পথশিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প কমিটির মাধ্যম নতুন ভবন নির্মাণ কাজ রহস্যজনক ভাবে চার বছর পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছিল। এতে বিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ভবনটি ধ্বংসের দারপ্রান্তে দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। স্কুলটিকে বাঁচাতে তখন দুর্নীতি ও দায়িত্ব অবহেলার বিরুদ্ধে আমাকে প্রতিবাদ করতে হয়েছে। প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধে তখন চোরের মার বড় গলা প্রবাদ বাক্যের মত কুচক্রী ও অপরাধিরা অপরাধ ও অপকর্ম ধামাচাপা দিতে আমার বিরুদ্ধে জেলার হাজার হাজার শিক্ষককে ভুল বুঝিয়ে রাজপথে নামিয়েছে। মানব বন্ধন, স্মারক লিপি, মিথ্যা অভিযোগসহ কতশত ষড়যন্ত্রের জাল ফেলেছে। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ এঁর সৎ, নিরপেক্ষ এবং বিচক্ষণ তদন্তে কুচক্রী, ষড়যন্ত্র এবং দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচিত হয়। পরিশেষে অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি অঞ্জনা খান মজলিশের অদম্য ইচ্ছা শক্তি, ধৈর্য এবং দক্ষ নেতৃত্বে ২০২১ সালের জুলাই মাস থেকে পুনরায় বিদ্যালয় ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। " কন্ঠ হারা পাখির মত / স্বপ্নহারা আঁখির মত/ গন্ধহারা ফুলের মত / সব হারালো যারা / আমি তাদের দলের মানুষ বলেই এমন আত্মহারা " কবির কবিতার মত যাদের যাপিত জীবন, চাঁদপুর শহরের বড় স্টেশন এলাকার মেঘনা পাড়ের বিভিন্ন বস্তিতে বসবাসরত সেসব ভাগ্যহত হতদরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত, শ্রমজীবী শিক্ষার্থীদের কলরবে গত ২৭ মার্চ ২০২২ খ্রিঃ থেকে মুখরিত হয় চাঁদপুর শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নবনির্মিত ভবন। বহু কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত বিদ্যালয়ের নবনির্মিত নান্দনিক ভবনটিতে অন্যান্য শ্রমজীবি, সুবিধাবঞ্চিত, পথ শিশুদের মত ইমন গাজীরও এখন প্রাথ‌মিক শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের ফুল ফুটাচ্ছে। মোঃ ইমন গাজী, বয়স দশ বছর, পিতা ইব্রাহিম গাজী, মা তানিয়া আক্তার। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে ইমন বাবা মার বড় সন্তান। থাকেন চাঁদপুর শহরের ৩নং কয়লা ঘাট বস্তিতে। ইমনের জন্ম হয়েছে এই বস্তিতে। বাবা ইব্রাহিম গাজী চাঁদপুর লঞ্চ ঘাটে হকারি করেন মা গৃহকর্মী। যে বয়সে ইমন লেখাপড়া, খেলাধুলা, হৈ হুল্লোড় করে শৈশবের দুরন্তপনা সময় পার করার কথা। সে বয়সে সে অবর্ণনীয় যন্ত্রণাকাতর শ্রমে নিয়োজিত থেকেও চাঁদপুর শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেনির ছাত্র হয়ে সম্পূর্ণ অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাও গ্রহণ করছে। ছোট্ট ইমনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেন, মা বলছে সামনে যেই দিন আইতেছে পড়ালেখা না করে উপায় নাই। পড়ালেখা না করলে সব কাজেই সমস্যা পড়তে হয়। আমার বাবা মা করে নাই। এখন বুঝে। ইমন প্রতিদিন কাক ডাকা ভোরে ডাকাতিয়া নদীতে নেমে পড়ে বড় সাইজের কাঁকড়া পাওয়ার অভিলাষে। সে যখন নদীতে ছাই পাতে তখন আপন মামা কাদির কাছে থাকে। কোন সমস্যা হলে মামা তাকে সহযোগিতা করে। নদীতে ছাই পেতে ইমন বাসায় এসে প্রস্তুতি নিয়ে স্কুলে চলে আসে। স্কুল থেকে গিয়ে দুপুরে নদী থেকে ছাই জাল উঠিয়ে কাঁকড়া গুলো যত্নসহকারে পাতিলে ডুকিয়ে শহরের নির্দিষ্ট করা বাসা বাড়িতে নিয়ে যায় বিক্রি করার জন্য। কাঁকড়ার সাইজ বড় হলে প্রতিদিন দেড়'শ থেকে দুইশত টাকা পায় আর ছোট সাইজের হলে সত্তর/ আশি টাকা পাই। ইমন কাঁকড়া বিক্রির টাকা প্রতিদিন তার মায়ের হাতে তুলে দেয়। মা তাকে দশ/ বিশ টাকা দেয়। এই টাকা থেকে ছোট ভাই এবং বোনকে কিছু কিনে দেয় এবং নিজেও কিছু খায়। ইমনের দেওয়া টাকা সন্তানদের পড়ালেখা ও সংসার খরচে ব্যয় করে তার মা। ক্লান্ত ইমন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, গত কয়েক দিন আগে মামাকে চাঁদপুর রেলওয়ে বড় স্টেশন থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। মাদক মামলায় মামা জেলে ছিলেন। তখন অনেক দিন কাঁকড়া ধরতে পারি নি। মা আমাকে একা নদীতে যাইতে দেয় নাই। মামা জেল থেকে আসার পর এখন আবার ধরতেছি। এখন শীতে নদীতে নামতে কষ্ট হয়। তারপরও জীবন বাঁচাতে নদীতে যাই। ছোট্ট ইমনের হৃদয় নিংড়ানো কথা গুলো শুনে চোখের নোনা জল গড়িয়ে গিয়ে যখন জিভের স্বাদ পায় তখন আবেগাপ্লুত হয়ে যাই। পকেট থেকে কিছু টাকা ইমনের হাতে দিয়ে বলি, ক্ষুদা লাগলে দোকান থেকে কিছু খেয়ে নিও। ইমনকে বিদায় দিয়ে নির্বাক হয়ে ভাবতে থাকি, বর্তমানে দেশে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৯১ ডলারে, যা দেশীয় মুদ্রায় ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা। অর্থাৎ ইমনের মত শ্রমজীবী, সুবিধাবঞ্চিত, পথশিশুদেরও গড় আয়ও ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা ! হতদরিদ্র ইমন দেশের গড় আয় এবং রিজার্ভ সম্পর্কে বুঝে না এবং এই গড় আয় কখনো তাদের পকেটে আসে না। ইমনদের পকেটে না থাকলেও রাষ্ট্রের তহবিলে থাকলেও তা মন্দ কী? কিন্তু ইমনদের কষ্ট হয় তখন রাষ্ট্রের অর্থ, সম্পদ, রিজার্ভ যখন এক শ্রেনির পুঁজিবাদ লুটেরা এবং দুর্নীতিবাজদের পকেটে চলে যায়। আবার সেই অর্থ কেউ কেউ বিদেশেও প্রাচার করে এবং 'সেকেন্ড হোম ' তৈরি করে। ইমনদের সমাজে দুর্নীতির সয়লাবে সুনীতি ও শুভ চেতনা পদে-পদে মার খাচ্ছে। দুর্নীতিই আজ যেন নীতি, অশুভই যেন শুভ বলে স্বীকৃত।রাজনীতির নামে ক্ষমতার সিঁড়ি মারানো এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের তসরূপ করে দুর্নীতির সম্পন্ন করার লীলা খেলায় মগ্ন থাকে কতিপয় স্বঘোষিত সাধু সন্যাস। অথচ, তাদের কাজে ও কর্মে, ভাষণে ও তোষণে সবখানে থাকে দুর্নীতি! যারা রক্ষক তারাই হয় ভক্ষক! মুখে সুনীতির বাণী অথচ কাজেকর্মে এবং চারপাশে যতসব দুর্নীতিবাজের হাতছানি! এসব দুর্নীতিবাজেরা জনগণের টাকা মেরে পকেট ভরলেও তাদের কারো কারো কোথাও জবাবদিহি করতে হয় না এবং শাস্তিও পেতে হয় না, হবে না এমনি তাদের ধারণা। রাষ্ট্রের অর্থ ও সম্পদ দূর্নীতির মধ্যে ফকির, মিসকিন, এতিম, ছিন্নমূল, শ্রমজীবী, পথশিশু ইমনদেরও মালিকানা রয়েছে। ফকির, মিসকিন, এতিম, ছিন্নমূল অসহায় প্রতিবন্ধীদের অর্থ সম্পদ দুর্নীতি করে মুখোশধারী সাধু সেজে সততার বাণী প্রচারকারীদের স্বরূপ উন্মোচনসহ তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে রাষ্ট্র ও সমাজকে অনেক সময় বেগ পেতে হয়। অতপরও দিন শেষে হয় সত্য ও সুন্দরেই জয়। যার প্রমান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদকের) দুর্নীতির মামলার জামিন শুনানিকালে দুর্নীতিবাজ প্রতারক সাহেদ করিমকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অশ্রুসজল চোখ ও কান্না জড়ানো কন্ঠে বলতে হয়, ' আমার স্ত্রী বাইরে যেতে পারে না, সবাই চোরের বউ বলে।' এই মুখোশধারী মানুষষের পরিচয় আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। অথচ, এই মুখোশধারী শব্দটির পেছনে লুকিয়ে থাকে ইমনদের আশা ভঙ্গ কিংবা স্বপ্ন ভঙ্গের করুন দৃশ্য! সর্বগ্রাসী এই দুর্নীতির কবলে পড়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতিপরায়ন সেরা দেশ হবার উপহাস কুড়িয়েছে বিগত দিনে। দুর্নীতির কারণেই বঙ্গবন্ধুর ক্ষুদা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে জননেত্রী শেখ হাসিনার নিরলস প্রচেষ্টা এবং কাঙ্ক্ষিত উন্নতি অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দুর্নীতি দেশ সমাজ ও জাতীয় জীবনের সকল উন্নতির অন্তরায়। দুর্নীতি জাতীয় জীবনের অভিশাপ স্বরূপ। দুর্নীতির ঘৃণ্য অপরাধ বর্তমানে আমাদের সমাজের সর্বত্র বিরাজমান। দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে জাতি মুক্ত না হলে ইমনদের জীবনের উন্নতি হবে সুদূর পরাহত।

Editor & Publisher: S. M. Mesbah Uddin
Published by the Editor from House-45,
Road-3, Section-12, Pallabi, Mirpur
Dhaka-1216, Bangladesh
Call: +01713180024 & 0167 538 3357

News & Commercial Office :
Phone: 096 9612 7234 & 096 1175 5298
e-mail: financialpostbd@gmail.com
HAC & Marketing (Advertisement)
Call: 01616 521 297
e-mail: tdfpad@gmail.com