১৯৫০ সালের পর থেকেই পৃথিবীর প্রায় সকল অঞ্চলে বেড়েছে তাপপ্রবাহের সংখ্যা ও স্থায়িত্ব। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে তাপপ্রবাহ বেড়ে চলার ঘটনা এই প্রথমবারের মতো অঞ্চলভিত্তিক তাপবৃদ্ধির ভিত্তিতে তুলে ধরে সাম্প্রতিক এক গবেষণা। পূর্ববর্তী নানা গবেষণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও তীব্র শঙ্কার জন্ম দিয়েছে।
গবেষণার তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যায়, একেক অঞ্চলে তাপপ্রবাহ একেক মাত্রায় দেখা দিয়েছে। যেমন; আমাজন জঙ্গল বা উত্তর-পূর্ব ব্রাজিল, পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলেই তাপপ্রবাহের সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তনের ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে- অধিকতর শুষ্ক অঞ্চল বলে পরিচিত দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া এবং অধিকতর শীতল অঞ্চল উত্তর এশিয়া বা সাইবেরিয়ার তুলনায়। মানব বসতি আছে এমন একমাত্র অঞ্চল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রবণতায় খুব একটা প্রভাবিত হয়নি, তুলনামূলক আলোচনায়।
প্রকৃতি বিজ্ঞানের শীর্ষ সাময়িকী জার্নাল ন্যাচারাল কম্যিউনিকেশন্স-এ সাম্প্রতিক গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। আলোচিত অঞ্চলগুলোয় কিছুদিনের ব্যবধানে নতুন তাপপ্রবাহ সৃষ্টি এবং সেগুলোর স্থায়িত্ব গত ৭০ বছর ধরেই বাড়ছে বলে জানানো হয় সেখানে।
প্রতি দশকে তাপপ্রবাহের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার ধারাবাহিকতা তুলে ধরা হয়েছে মৌসুম ভেদে। দেখা যাচ্ছে, প্রতি দশকে অঞ্চল ভেদে উষ্ণতা সর্বনিম্ন ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ আমেরিকার কিছু কিছু স্থানে তা এক দশকের ব্যবধানে ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্তও বাড়ে।
গবেষণার অন্যতম লেখক সারাহ পার্কিংস বলেন, ''বিগত ৭০ বছরে অধিক সংখ্যায় যেমন তাপপ্রবাহ বেড়েছে, ঠিক তেমনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্থায়িত্ব বাড়ছে। সাম্প্রতিক দশকে এই প্রবণতা খুবই গতিশীল হয়ে উঠেছে।''
প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক এ অনুসন্ধান; জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, আবহাওয়া পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো ঘটনাগুলোকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে।
বাংলাদেশের জন্য অশনি সঙ্কেত:
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সামুদ্রিক নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়ে তা সাইক্লোনে রূপ নেওয়ার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে। বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় দেশগুলোর জন্য যা এক ভয়াবহ দিনের সঙ্কেত দেয়।
মহাসমুদ্র পৃথিবীর সিংহভাগ তাপ শোষণ করে নেয়। একারণেই সাগরের পানির তাপমাত্রা বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। শুধুমাত্র ভারত মহাসাগরেই পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি একের পর এক শক্তিশালী সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম দিয়ে চলেছে বলে জানায়, ইউনিয়ন মিনিস্ট্রি অব আর্থ সায়েন্সের আরেকটি গবেষণা। গত ১৭ জুন এ গবেষণা প্রকাশিত হয়।
ছবি: মুমিত এম/ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
'অ্যাসেসমেন্ট অব ক্লাইমেট চেঞ্জ ওভার দ্য ইন্ডিয়ান রিজিওন' শীর্ষক গবেষণার মুখবন্ধে জানানো হয়েছে, ১৯৫১-২০১৫ সালের মধ্যে ভারত মহাসাগরের উপরিপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রা গড়ে এক ডিগ্রী সেলসিয়াস পরিমাণ বেড়েছে।
বিজ্ঞানীরা জানান, বৃহত্তর ভারত মহাসাগরের অংশ বঙ্গোপসাগরে জন্ম নেওয়া সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়গুলোও এই উষ্ণতাবৃদ্ধির ফসল। ফলে ঝড়ের সংখ্যা এবং তীব্রতা বাড়ার ঘটনা আর বিরল কোনো বিষয় নয়, বরং নিত্য-নৈমেত্তিক দুর্ভোগ এবং জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সৃষ্টি করছে ভারত ও বাংলাদেশের উপকূল জুড়ে।
৭০ বছর পর ঘূর্ণিঝড় নিসর্গের মুম্বাই উপকূলে হানা দেওয়া, বা ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে বাংলাদেশের উপকূল প্রভাবিত হওয়া এসব কিছুই; সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউড অব ট্রপিক্যাল মিটিওরলজির আবহাওয়া বিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথিউ কোল বলেন, আম্পান যখন আঘাত হানে তখন বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা ছিল ৩০ থেকে ৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আর নিসর্গের আগে আরব সাগরের পানির উপরিতলের উষ্ণতা ছিল ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এ ধরনের উচ্চ তাপমাত্রার ফলেই সেখানে সামুদ্রিক আবহাওয়া নিম্নচাপের জন্ম দেয়- যা পরবর্তীতে সাইক্লোনে রূপ নিয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবিত দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম বলে ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, বার্লিনভিত্তিক পরিবেশ গবেষণা সংস্থা- গ্রিনওয়াচ। সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশের উপকূলে লবণাক্ত পানির ছোবলে এমনিতেই বিপর্যস্ত কৃষিকাজ। অন্যদিকে মেরুর বরফ গলে সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি যেমন হচ্ছে, ঠিক তেমনি তাপমাত্রার প্রভাবে সাগরের পানির প্রসারণও বেড়েছে। বেড়েছে লবণাক্ততাও।
ছবি: মুমিত এম/ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
চলতি বছরে প্রকাশিত ফ্রান্সের লা রোশেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক আন্তর্জাতিক গবেষণায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে বলে জানানো হয়। সেখানে বলা হচ্ছে, ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রের পানির উচ্চতা ১৪০ সেন্টিমিটার বাড়বে। পূর্ব ধারণার চাইতেও এটা দ্বিগুণ।
এ গবেষণায় অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়- বুয়েট। গত ৬ জানুয়ারি প্রকাশিত ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ এবং ভারতের কিছু সমুদ্র উপকূলে দ্বিগুণহারে উচ্চতা বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকায় তা উপকূলবাসীর জীবনযাত্রাকে চরমভাবে প্রভাবিত করতে চলেছে।
রোশেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার সহ-লেখক ছিলেন বুয়েটের ইনস্টিটিউড অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট- এর অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ''জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) ২১০০ সাল নাগাদ ১ মিটার পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির অনুমান করছে। কিন্তু অঞ্চলভেদে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির তারতম্য হবে। আমাদের গবেষণা সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।''
এসময় তিনি আরও বলেন, সমুদ্রের আগ্রাসনে উপকূলে ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। তাই সেখানকার বাসিন্দারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হতে চলেছেন। লোনা পানির অনুপ্রবেশ, ভূমিহীন মানুষের জীবিকাহীনতা; অভ্যন্তরীণ শরণার্থীর পরিমাণ বাড়াবে। সাগরের উচ্চতার বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের রক্ষাকবচ সুন্দরবনও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
Editor & Publisher: S. M. Mesbah Uddin
Published by the Editor from House-45,
Road-3, Section-12, Pallabi, Mirpur
Dhaka-1216, Bangladesh
Call: +01713180024 & 0167 538 3357
News & Commercial Office :
Phone: 096 9612 7234 & 096 1175 5298
e-mail: financialpostbd@gmail.com
HAC & Marketing (Advertisement)
Call: 01616 521 297
e-mail: tdfpad@gmail.com