গত বুধবার দ্য ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে— চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢোকার পথে একটি স্ট্রেচারে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে শাওন নামে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশু এবং মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বিলাপ করছেন তার দাদা। ছবিটি দেশের সব বাবা-মা ও দাদা-দাদিসহ সাধারণ নাগরিকের হৃদয়ে বেদনা, ক্ষোভ আর হতাশার অনুভূতি তৈরি করবে।
ছবিটি বেদনার কারণ, শিশুদের ক্ষেত্রে এই ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনা মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। ক্ষোভ হবে কারণ, সহজেই এড়ানো যেত। হতাশার কারণ, এই ধরনের পরিস্থিতি যাতে আর না তৈরি হয়, তার জন্য কিছুই করা হবে না এবং হৃদয়বিদারক ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
বাড়ির কাছে খেলার সময় তিন চাকার একটি যান ধাক্কা দেয় শিশু শাওনকে। এরপর শাওনের বাবা-দাদা মিলে একের পর এক চারটি হাসপাতাল ঘুরেও তাকে কোথাও ভর্তি করাতে পারেননি। চিকিৎসা না দেওয়ার কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যাও দেয়নি কোনো হাসপাতাল। দরিদ্র হওয়ায় তারা এর কারণ জিজ্ঞাসা করারও সাহস পাননি। অবশেষে তারা যান চমেক হাসপাতালে। সেখানকার ডাক্তাররা শাওনের কাছে গেলেও, তাকে আর বাঁচানো যায়নি। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে যে সময় নষ্ট হয়েছে, শিশু শাওনকে তার মূল্য দিতে হয়েছে জীবন দিয়ে। চিকিৎসা বঞ্চিত করে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে শিশুটিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হলো।
রাজধানীর মহাখালীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চের (এনআইসিআর) ঢোকার পথে এভাবেই মাকে সঙ্গে নিয়ে মেঝেতে ঘুমান ৩৫ বছর বয়সী এক নারী ক্যানসার রোগী আমেনা বেগম। ছবি: আনিসুর রহমান
৩৫ বছর বয়সী এক নারী ক্যানসার রোগীর ছবি ছাপা হয়েছিল। গত ৮ জুন টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে চিকিৎসার জন্য ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চে (এনআইসিআর) আসেন আমেনা বেগম নামের ওই নারী। কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার জন্য তাকে ১১ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে জানানো হয়। নমুনা দিতে এনআইসিআর থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরের মুগদা হাসপাতালে যান তিনি।
গত ১৬ জুন যখন আমাদের ফটোসাংবাদিকের সঙ্গে তার দেখা হয়, তখন পর্যন্ত তিনি পরীক্ষার ফল পাননি। ঢাকায় আসার পর থেকেই সঙ্গে থাকা মাকে নিয়ে হাসপাতালের একটি খোলা জায়গায় রাতে ঘুমাচ্ছেন আমেনা বেগম। কারণ, ঢাকায় ভাড়া দিয়ে কোথাও থাকার মতো আর্থিক সক্ষমতা তার নেই। মুগদা হাসপাতালে কোভিড-১৯ পরীক্ষার যে চাপ তাতে রিপোর্ট পেতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
১০ মাস বয়সী শিশুকে কোলে আঁকড়ে ধরে চট্টগ্রামে একটি সড়কের বিভাজকের ওপর বসে আছেন মরিয়ম আক্তার নামে এক অসহায় মা। কোভিড-১৯ সার্টিফিকেট না থাকায় তার শিশু রাফাকে চট্টগ্রাম হাসপাতালে ভর্তি করানো যায়নি। এর আগে লিভারের রোগে তাকে দুই সন্তান হারাতে হয়েছিল। রাফাকেও হারানোর ভয় জেঁকে বসেছিল তার মধ্যে। ছবি: রাজীব রায়হান
বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, সেগুলো তুলে ধরে আমরা গত ১৬ জুন কিছু ছবি প্রকাশ করেছিলাম। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছিল— ১০ মাস বয়সী শিশুকে কোলে আঁকড়ে ধরে চট্টগ্রামে একটি সড়কের বিভাজকের ওপর বসে আছেন মরিয়ম আক্তার নামে এক অসহায় মা। কোভিড-১৯ সার্টিফিকেট না থাকায় তার শিশু রাফাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো যায়নি। ছবিতে মরিয়মের চেহারায় যে হতাশা দেখা যাচ্ছিল তা অবর্ণনীয়। কারণ, এর আগে লিভারের রোগে তাকে দুই সন্তান হারাতে হয়েছিল। রাফাকেও হারানোর ভয় জেঁকে বসেছিল তার মধ্যে।
আরেকটি ছবি ছিল কক্সবাজারের এক রোগীর। স্ট্রোক করা ওই রোগীকে নিয়ে স্বজনরা হাসপাতালের এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে ছুটে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু, এই রোগীকে নিয়ে ঠিক কোথায় যেতে হবে, সেই ব্যাপারে তাদের সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না। আমরা ভালো করেই জানি যে স্ট্রোকের রোগীদের জন্য প্রত্যেকটি মিনিট নয়, প্রত্যেকটি সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ।
গত ১৫ জুন আমরা রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালের নার্স হাবিবা সুলতানার (২২) হৃদয়বিদারক ঘটনার কথা তুলে ধরেছিলাম। যে হাসপাতালে তিনি কাজ করতেন, সেই হাসপাতালই তাকে ভর্তি করায়নি। শেষে হাসপাতালের সামনেই তার মৃত্যু হয়। ভর্তি না করানোর কারণ, তার কোভিড-১৯ নেগেটিভ সার্টিফিকেটটি হারিয়ে গিয়েছিল।
গত ১০ জুন হাবিবা স্ট্রোক করেন এবং তাকে জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। যখন হাবিবার অবস্থার অবনতি হয়, চিকিৎসকরা জানান তার জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) প্রয়োজন। কিন্তু, সে সময় হাসপাতালের কোনো আইসিইউ ফাঁকা ছিল না। তাই চিকিৎসকরা তাকে অন্য কোথাও নেওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর তার স্বজনরা তাকে ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাবিবা যেহেতু এই হাসপাতালে কাজ করতেন, তারা অনেকটা নিশ্চিত ছিলেন যে হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হবে।
নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা হাবিবার ফাইলে লিখে দিয়েছিলেন যে সে করোনা নেগেটিভ। টেলিফোনে ওই হাসপাতাল থেকে ইবনে সিনায় কোভিড-১৯ টেস্টের কথা জানানো হয়। কিন্তু, ইবনে সিনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে রাজি করানো যায়নি। তারা হাবিবাকে ভর্তি করেনি এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
সিলেটের এক অসুস্থ নারীকে অ্যাম্বুলেন্সেই অক্সিজেন দিয়ে রাখঅ হয়েছে। তিনি করোনা পরীক্ষার নমুনা দেওয়ার টোকেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ছবিটি ১২ জুন শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদ হাসপাতাল থেকে তোলা। ছবি: শেখ নাসির
আমরা সিলেটের অসুস্থ এক নারীর ছবি প্রকাশ করেছি, যিনি অক্সিজেন মাস্কের সাহায্যে শ্বাস নিচ্ছিলেন এবং অ্যাম্বুলেন্সে বসে করোনা পরীক্ষার নমুনা দেওয়ার টোকেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু, নমুনা দিতে কতক্ষণ সময় লাগবে, সেই ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই ছিল না। কোভিড-১৯ পরীক্ষা আগে তো তিনি কোনো চিকিৎসা বা চিকিৎসকের কাছে থেকে পরামর্শ পাবেন না। রোগীদের অবস্থা কতটা গুরুতর, তা বিবেচনা না করেই শত শত রোগীকে করোনা পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ সময় হাসপাতালে অপেক্ষা করতে হয়।
গত ১৩ জুন আমরা দুজন ক্যানসার রোগীর ছবি প্রকাশ করেছিলাম। তাদের একজন ৮ বছর বয়সী ছেলে, অপরজন ১৩ বছরের মেয়ে। দুই জনকেই কোভিড-১৯ টেস্ট রিপোর্ট ছাড়া কেমোথেরাপি দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছিল। করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেওয়ার চেষ্টা করেই তাদের দিন কেটে যায়। নমুনা দেওয়ার পর আবার শুরু হবে রিপোর্টের জন্য অপেক্ষার পালা।
অসুস্থতার কারণে পড়ে যাওয়ার পর আবদুল কুদ্দুসের গায়ে একটি শাল জড়িয়ে কয়েকজন মিলে তাকে উঠানোর চেষ্টা করছিলেন। পাশে আরেক নারী তার ছেলেকে শান্তনা দিচ্ছিলেন। ছবি: সংগৃহীত
গত ১১ জুন আবদুল কুদ্দুস নামে কুষ্টিয়ার এক হৃদরোগী, যিনি রাজশাহী রেলস্টেশন পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন তার সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। স্টেশনের বাইরে তার ছেলে-মেয়ে তাকে সহায়তা করছিল, তখন অসুস্থতার করণে তিনি মাটিতে পড়ে যান। কুদ্দুস করোনায় আক্রান্ত ভেবে তাদের আশপাশে থাকা সব লোক পালিয়ে যায়। কেউ তাকে সহায়তা করেনি এবং তাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য কোনো অ্যাম্বুলেন্সও আসেনি। সময় গড়িয়ে যায়, এক পর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন কুদ্দুস। এক পর্যায়ে পুলিশ এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরে অটোরিকশাতে তুলে দেয়। সেই অটোরিকশায় করে কুদ্দুসকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সময় মতো কেউ এগিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যেতেন আবদুল কুদ্দুস।
আমরা সবাই দুঃখের সঙ্গে অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকারের ঘটনার কথা স্মরণ করি, যিনি চারটি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গিয়েছেন। এর পর থেকে অবহেলায় আরও প্রায় ৫০টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৫টির বেশি মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
এখন পর্যন্ত আমরা একদিনে প্রায় ১৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করে করোনায় আক্রান্ত প্রায় চার হাজার জনকে শনাক্ত করেছি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে পারার জন্য এটা যথেষ্ট না। যারা পরীক্ষা করিয়েছেন বা উপসর্গের কারণে ফোন করে পরীক্ষা করাতে চেয়েছেন, এই নমুনাগুলো তাদের। আমাদের এখানে প্রতিদিন যে পরীক্ষা হচ্ছে তাতে সংক্রমিতের আসল সংখ্যা বা এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে বৈজ্ঞানিকভাবে তা ঠাহর করা যাচ্ছে না।
বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান বা থাইল্যান্ড, যারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবার চালু করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তাদের কাছ থেকে আমরা কিছুই শিখতে পারিনি।
প্রশ্ন হলো— ক্রমেই বেড়ে চলা করোনাভাইরাস সংক্রমণ আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব যখন, দেশের অপ্রতুল ও অত্যন্ত চাপে থাকা স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং উপরে বর্ণিত খবরের মতো দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামোর কারণে আমাদের চিকিৎসক ও নার্সরা অগ্রহণযোগ্য ও মর্মান্তিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। যে কথাগুলো বারবার বলা হচ্ছে তা যদি বাস্তবতার সঙ্গে আদৌ না মেলে, তা বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব আরও বাড়িয়ে দিতে পারে, যা এই মহামারিকালে সবচেয়ে খারাপ বিষয় হয়ে উঠবে।
মাহফুজ আনাম, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক
Editor & Publisher: S. M. Mesbah Uddin
Published by the Editor from House-45,
Road-3, Section-12, Pallabi, Mirpur
Dhaka-1216, Bangladesh
Call: +01713180024 & 0167 538 3357
News & Commercial Office :
Phone: 096 9612 7234 & 096 1175 5298
e-mail: financialpostbd@gmail.com
HAC & Marketing (Advertisement)
Call: 01616 521 297
e-mail: tdfpad@gmail.com