দেশের শ্রমবাজারের গতিপ্রকৃতি তুলে ধরতে তিন মাস অন্তর শ্রমশক্তি জরিপ করার কথা থাকলেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর এমন কোন আয়োজন করেনি বিবিএস।
যখন দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা আসে, তখন সঠিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথ্য-উপাত্ত থাকা জরুরি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু, দেখা গেছে যে, প্রায়ই তাদের তথ্য অচল কিংবা অসম্পূর্ণ থাকে। এর থেকেও মারাত্মক অভিযোগ হলো তাদের তথ্য প্রায়ই বানোয়াট থাকে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
দারিদ্র্যের হার পরিমাপে বিবিএসের অনুসরণকৃত পদ্ধতির কথাই ধরা যাক। ধারণা করা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) এক শতাংশ পর্যন্ত বাড়লে দশমিক ২৫ শতাংশ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। এর সুবাদে দারিদ্র্যের হারও কিছুটা কমে আসে।
এ অনুমানকে সংখ্যাতাত্ত্বিক রূপ দিয়ে দেশে ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর সময়কালে গরিব মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ কমেছে বলে দাবি করছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)।
একইভাবে কোন জরিপ ছাড়াই সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার(২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর) প্রথম চার বছরে দেশে ৭৪ লাখ নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছে সংস্থাটি।
দেশের শ্রমবাজারের গতিপ্রকৃতি তুলে ধরতে তিন মাস অন্তর শ্রমশক্তি জরিপ করার কথা থাকলেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর এমন কোন আয়োজন করেনি বিবিএস।
মাথাগুনতি দারিদ্র্য হার, খানাপ্রতি আয়, ব্যয়, সঞ্চয়, খাবার গ্রহণের প্রবণতা এবং অসমতাসহ আর্থসামিাজিক বিভিন্ন সূচকের সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পর করা হয়নি খানা আয়-ব্যয় জরিপ বা হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস)।
এর ফলে, দেশের আর্থ-সামাজিক অনেক সূচকের তথ্য দিতে পারছে না বিবিএস। কিছু সূচকে তথ্য প্রকাশ করলেও তা অপূর্ণাঙ্গ এবং অনুমান নির্ভর।
করোনার কারণে কাজ হারিয়ে অন্তত তিন কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্য বরণ করেছেন বলে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে এমন পরিসংখ্যানের কোন স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় নতুন জরিপ করে দরিদ্র মানুষের প্রকৃত সংখ্যা তুলে ধরতে বিবিএসকে তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, কোন কারণে জরিপ না হলে আগের দুই বছরের তথ্যের ভিত্তিতে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য হারের প্রবণতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু জরিপ না করে কখনই বলা যায় না যে, এত মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বা দারিদ্র্য এত কমেছে।
তিনি বলেন, শ্রমঘন শিল্পের বাইরে উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হলে কর্মসংস্থানের পরিমাণ নাও বাড়তে পারে। আবার প্রবৃদ্ধি সব সময় সমান হারে দারিদ্র্য বিমোচন নাও করতে পারে।
দুর্বল অনুমানের তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার খুব একটা মিল থাকে না বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এমন তথ্যের ভিত্তিতে বড় ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে তা বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ এইচআইইএস জরিপের প্রতিবেদন ২০১৬ সালে প্রকাশ করার কথা থাকলেও এ কাজ শেষ করতে বাড়তি সময় লাগে তিন বছর।
২০১৯ সালে জরিপের চূড়ান্ত ফলাফল তুলে ধরতে আয়োজন করা সংবাদ সম্মেলনে বিবিএস জানায়, ২০১০ সালের ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে মাথাগুনতি দারিদ্র্য হার ২০১৬ সালে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ২১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমেছে বলেও একই অনুষ্ঠানে দাবি করে বিবিএস।
একই জরিপের মাধ্যমে ভিন্ন দারিদ্র্য হারের সংখ্যা নিয়ে শুরু হওয়া বিভ্রান্তির অবসান হয়নি এত বছরেও।
চাকুরির বাজারের পরিস্থিতি তুলে ধরতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পরিচালিত বিবিএস এর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বেকারত্বের হার ছিল ৪.২ শতাংশ, যা এর আগের বছরের সমান।
বছরের বিভিন্ন সময়ে কর্মসংস্থানের গতিপ্রকৃতি ও মৌসুমী কর্মহীনদের সংখ্যা তুলে আনতে প্রতি চার মাসে শ্রমজরিপ করার কথা থাকলেও গত চার বছরে এ সংক্রান্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিবিএস।
ত্রৈমাসিক জরিপ পরিচালনা করা হলে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই শ্রমবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব জানা যেত বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অবশ্য পরিসংখ্যান না থাকলেও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম চার বছরে দেশে ৭৪ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করছে সরকার।
এইচআইইএস এবং শ্রমশক্তি জরিপ না করেই বাড়তি কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য কমে আসার তথ্যের উৎস অনুসন্ধান করে পাওয়া গেছে কিছু অনুমান ও প্রচলিত রীতি বা রুল অব থাম্বের ওপর নির্ভরতা।
বিবিএস এর দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচনের ইতিবাচক সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়ে সমীক্ষার পরবর্তী বছরগুলোর দারিদ্র্য হার প্রাক্কলন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১০ থেকে ২০১৬ সময়কালে এক শতাংশ মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিপরীতে ০.৭ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে। আগামী বছরগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একই হারে দারিদ্র্য বিমোচন করবে বলে ধারণা করেই নতুন হার হিসাব করা হয়েছে।
একইভাবে এক শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধির সুবাদে ০.২৫ শতাংশ কর্মসংস্থান বাড়বে, এমন ধারনার ভিত্তিতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির দাবি করেছে বিবিএস।
জানা গেছে, ১৯৭৪ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কৃষি পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি শুমারি কমিশন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আদমশুমারি কমিশনকে একত্রিত করে পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের অধীনে ন্যাস্ত করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। পরের বছর পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেখভালের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের আওতায় গঠন করা হয় পরিসংখ্যান বিভাগ।
২০০২ সালে এ বিভাগকে আবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একটি অংশে পরিণত করা হয়। ২০১০ সালে পুনরায় গঠন করা হয় পরিসংখ্যান বিভাগ, যা ২০১৩ সালে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে (এসআইডি) রূপান্তর করা হয়।
ঢাকায় প্রধান সদর দপ্তর ছাড়াও পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় আলাদা অফিস রয়েছে। সংস্থাটির সব মিলে জনশক্তি দুই হাজার ২৩৪ জন। এর বাইরে এসআইডিতে আরও প্রায় ১০০ জন কর্মী রয়েছেন।
সংস্থাটির নিয়মিত কার্যক্রম ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় গত অর্থবছর বরাদ্দ ছিল ৬৬৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এ সংস্থায় ১০০ টাকা ব্যয় হলে ৯৯.৪০ টাকাই দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রাখে বলে দাবি করে থাকে সরকার।
নয় বছরেও হয়নি দরিদ্রদের ডেটাবেজ
সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম আর যে কোন দুর্যোগে সহায়তা কার্যক্রমের সম্ভাব্য সুবিধাভোগীদের দ্রুত চিহ্নিত করতে আয়ের ভিত্তিতে দেশের সব মানুষের ডেটাবেজ বা তথ্যভান্ডার তৈরি করতে ২০১৩ সালে নেয়া ন্যাশনাল হাউজহোল্ড ডাটাবেজ (এনএইচডি) প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি গত নয় বছরেও। ৩২৮ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ৭২৭ কোটি টাকায় দাঁড়ালেও আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ২০ শতাংশ।
২০১৪ সালেই এর কাজ শেষ হয়ে যাবে এমন ধারণা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পে ছয় লাখ নারীকে মাতৃত্বকালীন ভাতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। সুবিধাভোগী চিহ্নিত না হওয়ায় বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পের পাঁচ কোটি ডলার কেটে নিয়েছে। বিকল্পপন্থায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা নেমে এসেছে চার লাখে।
বিবিএস সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের আওতায় এখনও এমআইএস নির্মাণ শেষ হয়নি। তাছাড়া ডাটাবেজের জন্য সংগৃহীত তথ্যেও বিভিন্ন ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে।
এদিকে আগামী দুই বছরেও দারিদ্র্য হারের চূড়ান্ত তথ্য পাওয়া সম্ভব হবে না বলে পরিসংখ্যান ব্যুরোর বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করে জানা গেছে।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, নতুন খানা আয় ব্যয় জরিপ পরিচালনা করতে গত বছরের শুরু থেকে বাস্তবায়নে আসা প্রকল্পে এ পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র আড়াই শতাংশ।
প্রকল্পের আওতায় কম্পিউটার ক্রয়ে ই-জিপিতে টেন্ডার আহ্বান করা হলেও কোন সাড়া না পাওয়ায় দ্বিতীয় বারের মতো টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
গত মাসের মধ্যে মাঠ পর্যায়ে সার্ভে করার কথা থাকলেও তা এখনও শুরু হয়নি করোনার কারণে। সংশ্লিষ্টদের অদূরদর্শীতার কারণে এ কাজে অগ্রগতি হয়নি বলে এক সভায় মন্তব্য করেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ইয়ামিন চৌধুরী।
জানতে চাইলে প্রল্পটির পরিচালক পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপসচিব ড. দীপঙ্কর রায় জানান, করোনার কারণে কাজ শুরু হতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তা ছাড়া এখন জনশুমারির কাজ চলছে, যা ২০২২ সাল পর্যন্ত চলবে। এর পর নতুন এইচআইইএস প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।
গরীবের পরিসংখ্যানে কাঁটছাট
দরিদ্র মানুষের আয়, ব্যয়, জীবনযাত্রার মান নির্ধারণসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জরিপ একেবারেই বাতিল করেছে বিবিএস।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকা মহানগরীর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য পৃথক একটি ভোক্তা মূল্যসূচক প্রকাশের ধারবাহিকতা থাকলেও ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরের পর এ সংক্রান্ত কোন তথ্য প্রকাশ করছে না বিবিএস।
কৃষি পণ্যের পাইকারি ও খুচরা দামের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য থাকায় উৎপাদক ও ভোক্তারা ঠকছেন। অথচ ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা বাদ দিয়েছে সরকারের পরিসংখ্যান সংস্থা।
নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনার শিল্প শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয়সূচক প্রতিবেদনটিও প্রকাশ হচ্ছে না একই অর্থবছর থেকে।
এছাড়া, প্রকাশ হচ্ছে না শিল্প শ্রমিকদের ভোক্তা মূল্যসূচক ও প্রকৃত মজুরি হার।
পিছিয়ে শিল্প সংক্রান্ত জরিপ
কৃষি খাতের বাইরে অর্থনৈতিক ইউনিট তথা শিল্প ও সেবা খাতের সবগুলো প্রতিষ্ঠানের তথ্য তুলে ধরতে সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারির আয়োজন হয় ২০১৩ সালে। গত আট বছরে জিডিপির আকার প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। যোগ হয়েছে নতুন নতুন খাত। তবে আট বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন শুমারি আয়োজনের কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না বিবিএস।
কটেজ ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা তুলে ধরতে সার্ভের আয়োজন হয়েছিল সর্বশেষ ২০১১ সালে। আইসিটি খাত নিয়ে সমীক্ষা হয়েছিল এর দুই বছর পর।
প্রতিবেদন প্রকাশে লাগে বাড়তি সময়
২০১৭ সালে শুরু হওয়া কৃষি শুমারির চূড়ান্ত রিপোর্ট এর পরের বছর প্রকাশ করার কথা থাকলেও এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি। এ সংক্রান্ত প্রকল্পের মেয়াদ গত বছর শেষ হয়ে যাওয়ার আগে প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদনের কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
প্রকল্পটি নিয়ে আয়োজিত পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক সভায় কৃষি উইং কর্তৃক প্রধান ফসল উৎপাদনের প্রতিবেদন সময়মতো না আসায় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি করা হয়েছে।
তিন বছর ধরে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে এক পৃষ্টার একটি সারসংক্ষেপ ২০১৯ সালে প্রকাশ করা হয়েছে। এর আরও দুই বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকাশ হচ্ছে না চূড়ান্ত প্রতিবেদন।
২০১৬ সালে পরিচালনা করা খানা আয় ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল ২০১৯ সালে। দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন গবেষণায় এই সমীক্ষার ডেটা ব্যাপকভাবে ব্যবহার হলেও তা প্রকাশ করতে বাড়তি সময় লাগে তিন বছর।
অর্থনীতিবিদ ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, কোনো এক বছর একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হলে এর তথ্য দিয়ে পরের বছরের অবস্থা কিছুটা অনুমান করা যায়। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে জরিপ করা উচিত। বিশেষ করে আয়, ব্যয় ও কর্মসংস্থান নিয়ে জরিপগুলো নিয়মিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশে এমনিতেই নিয়মিত অনেক জরিপ হচ্ছে না। এ অবস্থায় তিন চার বছর বাড়তি সময় লাগলে জরিপের ফলাফল যাই হোক না কেন এ তথ্য কোন কাজে লাগে না।
পুরনো ভিত্তির কারণে তথ্যে বাড়ছে অসঙ্গতি
করোনার কারণে ঢাকার প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। এর ফলে বাড়ি ভাড়া খুব একটা না কমলেও বাড়েনি। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর বাড়ি ভাড়া সূচক বলছে, গত এক বছরে রাজধানীর বাড়ি ভাড়া ৬.১৮ শতাংশ বেড়েছে।
বাড়ি ভাড়ার এ অসঙ্গতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারা জানান, ৪৭ বছর আগের ভিত্তিতে বর্তমানে বাড়ি ভাড়ার সূচক হিসাব করা হয়ে থাকে। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের পর আর সূচকটির ভিত্তি হালনাগাদ করা হয়নি।
১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে কোয়ান্টাম ইনডেক্স অব স্মল স্কেল ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ হিসাব করছে বিবিএস। অন্যদিকে, বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস প্রাইজ ইনডেক্স ইন বাংলাদেশ সহিসাব করা হচ্ছে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে।
আর মূল্যস্ফীতি, জিডিপি, কোয়ান্টাম ইনডেক্স অব ইন্ডাসট্রিয়াল প্রোডাকশন এবং প্রাইজ ইন্ডিসিস অব দ্য ডমেস্টিকালি প্রডিউসড ইন্ডাস্ট্রিয়াল গুডস- এর হিসাব করা হয়, ১৫ বছরের পুরাতন ভিত্তির ওপর নির্ভর করে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সময়ের পরিবর্তনের সাথে অর্থনীতিতে নতুন নতুন খাতের সংযোজন ঘটে। আবার অনেক খাত হারিয়েও যায়। এ কারণে হিসাবের ভিত্তি বছর যত পুরাতন হবে, হিসাবে অসঙ্গতিও তত বাড়বে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিডিপির ভিত্তি বছর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে হালনাগাদ করার কাজ করছে সংস্থাটি। চলতি অর্থবছরের মধ্যে এ কাজ শেষ করার কথা থাকলেও করোনার কারণে কিছু জরিপ করতে না পারায় তা সম্ভব হচ্ছে না।
সাম্প্রতিক জরিপে নেই করোনার প্রভাব
২০১৯ সালে শুরু করা ট্রাভেল এজেন্ট, ট্র্যুর অপারেটর অ্যান্ড ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট নিয়ে সমীক্ষার প্রতিবেদন গত বছরের জুলাইয়ে প্রকাশের আগেই করোনার প্রভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি খাত।
করোনার সময়ে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিবেদনটিতে ব্যবহার করা হয়েছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তথ্য। করোনার প্রভাব সম্পর্কে এ প্রতিবেদনে একটি লাইনও বলা হয়নি।
গত বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত আরবান সোশিওইকোনমিক অ্যাসেসমেন্ট শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত খাদ্য না থাকায় নগর এলাকার ২১.২৫ শতাংশ মানুষ চিন্তিত থাকেন। পছন্দের খাবার খেতে পান না ২০.৬৪ শতাংশ মানুষ। প্রতিবেদনটিতে নগর এলাকার মানুষের চাকরি, খাবার, বাসস্থান,স্বাস্থ্যসম্মত পানি ও স্যানিটেশন সমস্যার চিত্র উঠে এসেছে। তবে করোনার প্রথম ধাক্কায় এসব সূচকে কী ধরনের অবনতি হয়েছে তা প্রতিবদনটিতে উঠে আসেনি।
একইভাবে করোনার প্রভাব হিসাব করা হয়নি কস্ট অব মাইগ্রেশন সার্ভে বাংলাদেশ, ২০২০ শীর্ষক প্রতিবেদনে।
করোনার অভিঘাত তুলে ধরতে যা করছে বিবিএস
করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে গত দেড় বছরে অর্থনীতিতে এর অভিঘাত তুলে ধরতে এ পর্যন্ত বিবিএস দুইটি সমীক্ষা পরিচালনা করলেও এর কোনটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি।
হাজারখানেক মোবাইল ফোন গ্রাহকের টেলিফোনে দেয়া মতামতের ভিত্তিতে তৈরি "জীবিকার ওপর ধারণা জরিপ" এর প্রকাশিত সারসংক্ষেপে বিবিএস গত অক্টোবরে জানায়, দিনমজুর ছাড়া সব ধরনের শ্রমজীবী করোনার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাজে ফিরেছেন।
তবে বেকারত্বের হার, করোনায় আয় ও ব্যয় হ্রাসের মাত্রা নিয়ে প্রতিবেদনটিতে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। এতে বলা হয়, গত বছরের মার্চ মাসে বেকারত্বের হার ছিল ২.৩ শতাংশ। যদিও শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী বেকারত্বের হার ২০১০ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সময়ে ৪.২ শতাংশের আশেপাশে অবস্থান করছে।
খানা প্রতি আয়ের হার করোনাকালীন সময়ে ২০.২৪ শতাংশ কমলেও ব্যয় মাত্র ৬.১৪ শতাংশ কমেছিল বলে প্রতিবেদনে জানায় বিবিএস।
স্বাস্থ্যখাত নিয়ে বিবিএস অন্য একটি জরিপ করলেও তার ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি। তবে সাংবাদিকদের একটি কর্মশালায় প্রতিবেদন থেকে উদ্বৃতি দিয়ে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব জানিয়েছিলেন, করোনায় যত মানুষ মারা গেছে তার কয়েকগুণ মরেছে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। তিনি করোনার পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে ভাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্যে ধুম্রজাল
দুই অর্থবছর ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি বিবিএস। এর ফলে মোট উৎপাদনে করোনা মহামারির প্রভাব সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
শেষ কয়েক মাসের লকডাউনসহ করোনার নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনা না করেই গত অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫.২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে প্রাথমিক হিসাব করে জানায় বিবিএস। অথচ বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুযায়ী ওই বছরের প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৪ শতাংশ। অর্থবছর পেরিয়ে আরও এক বছর পার হলেও জানা যায়নি প্রকৃত চিত্র।
চলতি অর্থবছরে ৩.৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। অন্যান্য সংস্থার প্রাক্কলনও এর আশেপাশে। তবে সরকারের ধারণা তা ছয় শতাংশের বেশি হবে।
মে মাসের শেষ সপ্তাহে প্রতি বছরই চলতি অর্থবছরের জিডিপির প্রাথমিক প্রাক্কলন দিয়ে থাকে বিবিএস। অর্থবছর শেষে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে আসে চূড়ান্ত প্রদিবেদন। প্রচলিত ধারার বাইরে এসে গতবারের চূড়ান্ত প্রাক্কলন ও এবারের প্রাথমিক প্রাক্কলন বিলম্বিত হচ্ছে।
এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরে সাত শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যকে অনেকটাই গুরুত্বহীন বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুযায়ী গত বছরের ২.৪ শতাংশ ও চলতি বছরের ৩.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় নিলে জিডিপির ভিত্তি তুলনামূলক ছোট হবে। আর সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি হলে ভিত্তি অনেক বড় হবে। আগামী বছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কোন ভিত্তির ওপর হবে তা আগে নির্ধারণ করতে হবে।
দুই অর্থবছরে প্রকৃত জিডিপির আকার পাওয়া না গেলেও বাজারমূল্যে জিডিপি, জাতীয় আয় ও আরও কয়েকটি সূচকের তথ্য প্রকাশ হওয়ায় এ সংক্রান্ত বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে।
গত মাসে মন্ত্রী সভার বৈঠকে উপস্থাপন করা পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে বিবিএস জানিয়েছে, গত অর্থবছরে বাজারমূল্যে জিডিপির চূড়ান্ত আকার দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় যা, প্রাথমিক প্রাক্কলনের চেয়ে ৫৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা বা ২.০৪ শতাংশ কম। বাজারমূল্যে জিডিপি ২ শতাংশ কমলে মূল্যস্ফীতি বাদে প্রকৃত জিডিপি এক শতাংশের বেশি কমে আসার কথা।
নমিনাল জিডিপি ছাড়াও মাথাপিছু জাতীয় আয়সহ আরও কয়েকটি তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিএস। অর্থনীতিবিদ ড. আহসান মনসুর বলেন, বাজারমূল্যে জিডিপির আকার নির্ধারণ করার পর প্রকৃত জিডিপি বের করা কঠিন কোন কাজ নয়। মূল্যস্ফীতির হিসেব করে জিডিপি ডিফলেটরের মাধ্যমে সহজেই এটা করা যায়। আর স্বচ্ছতা ও অর্থনীতির নীতি প্রনয়ণের স্বার্থে এটা দ্রুত করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর দক্ষতা ও সক্ষমতার কিছু অভাব রয়েছে, এটা নতুন কিছু নয়। তাদের তৈরি করা পরিসংখ্যানের যথার্থতা নিয়ে সব সময়ই বিভিন্ন মহলের অভিযোগ ছিল। তবে সরকারের বিশেষ করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে তাদেরকে নির্ভুল পরিসংখ্যান প্রনয়ণের নিদেশনা দেয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, বিবিএস এর কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির আরও সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশনা ও সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
Editor & Publisher: S. M. Mesbah Uddin
Published by the Editor from House-45,
Road-3, Section-12, Pallabi, Mirpur
Dhaka-1216, Bangladesh
Call: +01713180024 & 0167 538 3357
News & Commercial Office :
Phone: 096 9612 7234 & 096 1175 5298
e-mail: financialpostbd@gmail.com
HAC & Marketing (Advertisement)
Call: 01616 521 297
e-mail: tdfpad@gmail.com